জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশের অন্য এলাকার মতো ভোটের হাওয়া বইতে শুরু করেছে ঢাকা-৬ আসনেও। পুরান ঢাকার প্রাণকেন্দ্র গুরুত্বপূর্ণ এই আসনে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিজ নিজ কৌশলে নির্বাচনী প্রচার শুরু করেছে। আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা প্রকাশ্যে নির্বাচনী প্রচার শুরু করলেও বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর প্রার্থীরা গোপনে নির্বাচনী প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছেন।
বর্তমানে এই এলাকায় মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির প্রভাবশালী নেতা কাজী ফিরোজ রশীদ সংসদ সদস্য থাকলেও আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা চাচ্ছেন আসনটি নিজেদের দখলে রাখতে। এ কারণে এবার সরাসরি দলীয় প্রার্থী নিয়ে মাঠে নামতে চায় আওয়ামী লীগ। সব দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা সরাসরি দলীয় মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩৪, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০, ৪১, ৪২, ৪৩, ৪৪, ৪৫ ও ৪৬নং ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত হয়েছে ঢাকা-৬, তথা জাতীয় সংসদের ১৭৯ নং আসনটি। এর অন্তর্ভুক্ত থানাগুলো হচ্ছে- ওয়ারী, গে-ারিয়া, সূত্রাপুর, কোতয়ালি ও বংশালের একাংশ। এ ছাড়া এর পশ্চিমে সিদ্দিক বাজার, উত্তরে ফুলবাড়িয়া-গুলিস্তান ও দক্ষিণে নাজিরা বাজারের অবস্থান। ঢাকা-৬ হচ্ছে পুরান ঢাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকার একটি। সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে এ আসনে মোট ভোটার ছিল দুই লাখ ৬৯ হাজার ২৭৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার এক লাখ ৪৩ হাজার ৮০ জন এবং নারী ভোটার এক লাখ ২৬ হাজার ১৯৬ জন। তবে আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটার আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। ইতোপূর্বে ’১৪ সালের নির্বাচনে মহাজোটে আওয়ামী লীগের শরিক জাতীয় পার্টিকে আসনটি ছেড়ে দেওয়া হয়।
জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন পান গোপালগঞ্জের সন্তান কাজী ফিরোজ রশীদ এবং তিনি বিজয়ী হন। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও মহাজোট থেকে নির্বাচিত হন তিনি। আসন্ন নির্বাচনেও তিনি প্রার্থী হবেন। নির্বাচনে অংশগ্রহণের পূর্ণ প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। তবে মহাজোটের হয়ে তিনি জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ইতোমধ্যে এই আসনে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতিসহ প্রচারও শুরু করে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ টানা ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার সুবাদে দেশের অবকাঠামো খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। ঢাকার যানজট নিরসনে মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে ও ফ্লাইওভার নির্মাণসহ নানা উন্নয়ন প্রকল্পের সুবিধা পেতে শুরু করেছে নগরবাসী। এ কারণে ঢাকার বেশিরভাগ আসনে বিগত দিনগুলোর মতো নৌকার প্রার্থীরা জয়লাভ করবে বলে মনে করছে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। এ লক্ষ্যে দলটির সম্ভাব্য প্রার্থীরা শুরু করেছে নির্বাচনী কর্মকা- ও প্রচার। এ ছাড়া আগামী নির্বাচনে শতাধিক আসনে নতুনদের সুযোগ দেওয়া এবং বিতর্কিত ও জনবিচ্ছিন্ন নেতাদের বাদ দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছে আওয়ামী লীগ।
অন্যদিকে, ঢাকা-৬ আসনেও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা এবার সরাসরি নির্বাচনে অংশ নিতে ইচ্ছুক। আসনটি জাতীয় পার্টিকে আর দিতে চান না তারা। তবে সবকিছু নির্ভর করছে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর। তিনি যাকে মনোনয়ন দেবেন দলীয় নেতাকর্মীরা শেষ পর্যন্ত তার পক্ষেই ভোটের মাঠে কাজ করবেন বলে জানা গেছে।
অপরদিকে সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে আন্দোলনের মাঠে আছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি। তবে ভেতরে ভেতরে দলটির নির্বাচনের প্রস্তুতিও রয়েছে। ঢাকা-৬ আসনে বিএনপির একাধিক প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন এবং মাঠে রয়েছেন।
ঢাকা-৬ আসন থেকে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী প্রার্থী হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবন্ধুর ¯েœহধন্য সাইদুর রহমান প্যাটেল। গত নির্বাচনে শক্তিশালী প্রার্থী ছিলেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের এই প্রতিষ্ঠাতা। এলাকার সন্তান হিসেবে তিনি খুবই জনপ্রিয় এবং প্রতিটি ঘরে বিচরণ রয়েছে। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই এলাকায় গণসংযোগ করে আসছেন এবং এলাকার মানুষের যে কোনো আপদে-বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েন। স্বাভাবিকভাবেই তিনিও এবার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে দলীয় মনোনয়ন চাইবেন। শেখ কামালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাইদুর রহমান প্যাটেল পুরান ঢাকায় বেশ জনপ্রিয় নেতা। বৃহত্তর সূত্রাপুর থানা ছাত্রলীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি।
গে-ারিয়ার স্থানীয় অধিবাসীরা মনে করেন, ক্লিন ইমেজের সাইদুর রহমান প্যাটেলকে একবারের জন্য হলেও সুযোগ দেওয়া উচিত। দলীয় প্রতীক নৌকা পেলে তিনি জনগণের ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন বলে আশা করছেন পুরান ঢাকার সাধারণ মানুষ।
এই আসনে সরকারি দলের আরেক শক্তিশালী প্রার্থী ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফি। তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করে এলাকায় নির্বাচনী কর্মকান্ড শুরু করেছেন। এ ছাড়া দীর্ঘদিন তিনি কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি মহানগর আওয়ামী লীগের দায়িত্ব পালনের সুবাদে তার ছেলে এখন ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়ে এলাকাবাসীর সঙ্গে কাজ করছেন। এর পাশাপাশি মন্নাফি নিজস্ব বলয় তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি বৃহৎ অংশ তার পক্ষে কাজ করছেন। সবকিছু মিলিয়ে তিনি আগামী নির্বাচনে শক্তিশালী প্রার্থী। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মনোনয়ন দিলেই কেবল তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। ইতোমধ্যে তিনি তার আগ্রহের কথা দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে প্রকাশ করেছেন। তবে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে তিনি প্রার্থী হবেন না বলে জানা গেছে।
ঢাকা-৬ আসনের সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত এবারও এলাকায় শক্তিশালী প্রার্থী কাজী ফিরোজ রশীদ। জাতীয় পার্টির এই নেতা মহাজোটের প্রার্থী হয়ে এবারও নির্বাচন করবেন। ইতোমধ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে তিনি এলাকাবাসীকে জানান দিয়েছেন। এমনকি আওয়ামী লীগ প্রার্থী দিলেও তিনি এককভাবে জাপা থেকে নির্বাচন করবেন। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মিলেমিশে তিনি এলাকার উন্নয়ন করেছেন। এ কারণে তার সঙ্গে কারও বিরোধ নেই এমন কথাও বলে থাকেন স্থানীয় অধিবাসীরা।
এ প্রসঙ্গে সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ জনকণ্ঠকে বলেন, তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন এবং তার সম্পূর্ণ প্রস্তুতি রয়েছে। মহাজোটের অংশ হয়ে প্রার্থী হওয়ার চেষ্টা করবেন তিনি। একই সঙ্গে বিএনপি যদি নির্বাচনে না আসে এবং জাপা এককভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সেক্ষেত্রে তিনি দলীয় প্রতীক লাঙ্গল মার্কা নিয়ে অংশগ্রহণ করবেন। এলাকার স্কুলÑকলেজের উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন ও দীর্ঘদিনের পানি সমস্যার সমাধান তিনি করে দিয়েছেন বলে জানান তিনি।
কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কারও সঙ্গে তার কোনো বিরোধ নেই। সবাইকে নিয়ে তিনি গত দশ বছর ধরে এলাকার উন্নয়নে কাজ করছেন। এ কারণে তিনি আবারও সুযোগ চান।
এ ছাড়া আসনটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে পারেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন। অবিভক্ত ঢাকার সাবেক প্রয়াত মেয়র হানিফের বড় পুত্র তিনি। এ ছাড়া তিনি পুরান ঢাকার মানুষ। মেয়র পদ হারানোর পর তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য পদ পেয়েছেন। তবে আলোচনা আছে, সাঈদ খোকনের আধিপত্য মাত্র কয়েকটি ওয়ার্ডে। আর মেয়র থাকাকালে তার কিছু নেতাকর্মী তৈরি হয়েছে। তবে তার চাইতেও ডজনখানেক গ্রহণযোগ্য ও হেভিওয়েট প্রার্থী এ আসনে আছেন। শুধু তাই নয়, ঢাকা-৬ আসন থেকে একাধিক ব্যবসায়ী নেতা আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে মুখিয়ে আছেন। দলটির হাইকমা-ের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন তারা। আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের সবুজ সঙ্কেত পেলে তারা নির্বাচনের মাঠে প্রচার শুরু করবেন।
এদিকে এ আসনটিতে বিএনপির অবস্থানও অনেক শক্তিশালী। নির্বাচনের মাঠে অনেকেই দেখতে চান সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ইশরাক হোসেনকে। যিনি গত সিটি নির্বাচনে ঢাকা দক্ষিণ থেকে শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে প্রতিদ্বন্ধিতা করে পরাজিত হয়েছিলেন। এ ছাড়া এই আসনে বিএনপির অপর সম্ভাব্য প্রার্থী ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কাজী আবুল বাশার। অভিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনে দীর্ঘ ১৮ বছর তিনি কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া তিনি দীর্ঘদিন মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সাধারণ সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। এলাকায় আবুল বাশারের নিজস্ব বলয় রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। বিএনপি নির্বাচনে এলে সেক্ষেত্রে আবুল বাশার প্রার্থী হতে পারেন।
জানা গেছে, ঢাকা-৬ আসনটি সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ। ইতোপূর্বে এই আসন থেকে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি থেকে হেভিওয়েট প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছেন। তবে দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালে এই আসন থেকে নৌকা প্রতীকে নির্বাচিত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা কোরবান আলী। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। ২০১৪ সালের পর থেকে এলাকার সংসদ সদস্য হিসেবে কাজ করছেন কাজী ফিরোজ রশীদ। এর আগে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন চলচ্চিত্রকার মিজানুর রহমান দীপু। ওই সময় তিনি বিএনপির সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকাকে বিপুল ভোটে পরাজিত করেছিলেন। তবে মিজানুর রহমান দীপুর মৃত্যুর পর ২০১৪ সালের নির্বাচনে মহাজোটের হয়ে জাপার কাজী ফিরোজ রশীদ সংসদ নির্বাচিত হন। সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে দ্বিতীয়বারের মতো এই আসন থেকে মহাজোটের প্রার্থী হয়ে তিনি নির্বাচিত হয়ে আসেন।
এর আগে ১৯৭৯ সালে এ আসনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে বিএনপি থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, ১৯৮৬-৮৮ সালে লাঙ্গল প্রতীকে জাপার আব্দুর রহিম, ১৯৯১ সালে বিএনপি থেকে মির্জা আব্বাস, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ থেকে সাবের হোসেন চৌধুরী এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি থেকে ফের মির্জা আব্বাস নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে আসন্ন নির্বাচনে এই আসনটি পুনরুদ্ধারে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা সরব হয়ে উঠেছেন। পুরান ঢাকার এই এলাকায় বিপুল সংখ্যক সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করেন। আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা মনে করেন, বরাবরই তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের ভোট পেয়ে আসছেন। এই ভোট নির্বাচনে তাদের বিজয়ী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ কারণে মহাজোটের শরিক দলকে মনোনয়ন না দিয়ে সরাসরি আওয়ামী লীগ থেকে এ আসনে প্রার্থী দিলে বিজয়ী হওয়া সহজ হবে বলে মনে করা হচ্ছে।