নিজস্ব প্রতিবেদক
নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অনড় অবস্থান এবং দুই দলের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ঘিরে রাজনীতিতে নানা ধরনের শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। ফলে এ বিষয় নিয়ে এত দিন যে সংকট চলছিল তা অক্টোবরে আরো ঘনীভূত হতে পারে বলে প্রচার আছে।
রাজনীতিচলতি অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহ কিংবা নভেম্বরের প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এ অবস্থায় বিএনপি চাচ্ছে তফসিল ঘোষণার আগেই আন্দোলনের মাধ্যমে সাফল্য পেতে।
আর আওয়ামী লীগ চাচ্ছে যেকোনোভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখে নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করতে। তাই রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে সক্রিয় থাকা ক্ষমতাসীন দল ও বিএনপিসহ সমমনা বিরোধী জোট অক্টোবর মাসকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
এ অবস্থায় সামনের দিনগুলোতে সংঘাত-সংঘর্ষের আশঙ্কা নিয়েও সংশ্লিষ্ট মহলে আলোচনা হচ্ছে। তফসিল ঘোষণার আগমুহূর্তে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কী হয় তা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও আছে।
কারণ এখন পর্যন্ত সংলাপ বা সমঝোতার বিষয়টি আলোচনায় স্থানই পাচ্ছে না। দুই দলের মধ্যে সংলাপের আয়োজন করতে তৃতীয় কোনো পক্ষও এগিয়ে আসার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালসহ সরকার পতনের এক দফা দাবিতে ধারাবাহিক কর্মসূচি দিয়ে আসছে বিএনপি। নির্দলীয় সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণাও দিয়েছে দলটি।
রাজপথেই চূড়ান্ত ফায়সালা করার কথা বলছে তারা।
আওয়ামী লীগও তাদের অবস্থানে অনড়। নির্বাচন প্রশ্নে সংবিধানের বাইরে যাবে না ক্ষমতাসীনরা। তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে দলীয় সরকারব্যবস্থায় নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি ও আওয়ামী লীগ তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে সরে আসাকে রাজনৈতিক পরাজয় মনে করে।
ফলে দুই দলের মধ্যে এক ধরনের জেদ আগেও ছিল, এখনো আছে। এই জেদাজেদি পরিস্থিতি সংঘাতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের এবারের নির্বাচন নিয়ে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে দেশি-বিদেশি শক্তিগুলো অনেক বেশি সক্রিয়। যুক্তরাষ্ট্র অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে বাধাদানকারী সরকার ও বিরোধী দলের রাজনীতিক এবং প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের ওপর ভিসানীতির প্রয়োগ শুরু করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নেও বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ে আলোচনা, প্রস্তাব তোলা হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার সংসদে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন একজন সংসদ সদস্য। সব মিলিয়ে নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিদেশিদের তৎপরতা বাড়তে শুরু করেছে।
তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য রাষ্ট্র বিজ্ঞানী হারুন-অর-রশীদ বলেন, ‘আমার মনে হয় না রাজনীতি সংঘাতের দিকে যাবে। বিএনপি হয়তো অবস্থান-ঘেরাও, হরতালের মতো কর্মসূচি দিতে পারে। তবে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়ে সমঝোতা হলে পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন হতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, নির্বাচনে যাওয়া ছাড়া বিএনপির বিকল্প নেই। কারণ, তাদের এক দফার আন্দোলনে সফল হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।’
কেন শঙ্কা
বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা জানান, নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার আগেই আন্দোলনের চূড়ান্ত সফলতা পাওয়া তাঁদের লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যে অক্টোবরে আন্দোলনের শেষ পর্যায়ের কর্মসূচি শুরু হতে পারে।
আর আওয়ামী লীগ বিএনপিকে এককভাবে রাজপথ দখলে রাখতে দেবে না। এরই মধ্যে নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। গত বছরের ১০ ডিসেম্বর বিএনপির কর্মসূচি ঘোষণার পর থেকে পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে মাঠে আছে আওয়ামী লীগ।
বিএনপির চলমান কর্মসূচি আগামী ৫ অক্টোবর শেষ হবে। এর পর ২০ অক্টোবর পর্যন্ত ধারাবাহিক কর্মসূচি দিতে পারে দলটি। সেই কর্মসূচি কেমন হবে তা নিয়ে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘জনগণের শঙ্কা ভোটাধিকার নিয়ে, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি না তা নিয়ে। জনগণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে চায়। কিন্তু তাদের সেই সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। জনগণের এই শঙ্কা কাটাতে আমরা আন্দোলন করছি। আন্দোলনে আমরা জনগণের সমর্থন পাচ্ছি।’
আর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নির্বাচন প্রতিহত করতে চাইছে। তারা রাজপথে সন্ত্রাস, নাশকতা করে একটি নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়। আমরা এর বিরুদ্ধে দেশের জনগণের জানমালের নিরাপত্তায় মাঠে থাকব।’
অক্টোবরজুড়ে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি
দুর্গাপূজার আগে ২০ অক্টোবর পর্যন্ত রোড মার্চ, পদযাত্রা, সমাবেশসহ ঢাকাকেন্দ্রিক নানা কর্মসূচি পালন করবে বিএনপি। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে চূড়ান্ত আন্দোলনে নেমে যেতে পারে দলটি।
দলীয় সূত্র জানায়, বিএনপি ধীরে ধীরে সচিবালয়, নির্বাচন কমিশন, সংসদ ভবন, বিচারঙ্গন, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও করার মতো কর্মসূচি দিতে পারে। প্রয়োজনে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচিও আসতে পারে বলে নেতারা ইঙ্গিত দিচ্ছেন।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘আন্দোলনের মাঠ থেকে তাঁরা আর সরবেন না। ধারাবাহিক কর্মসূচি চলবে। তিনি বলেন, সরকার দাবি না মানলে আমাদের আন্দোলনও কঠোর হবে।’
আওয়ামী লীগের দলীয় একাধিক সূত্র জানায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৪ অক্টোবর দেশে ফিরবেন। এদিন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গণভবন পর্যন্ত রাস্তার দুই ধারে উপস্থিত থেকে প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানানো হবে। ৭ অক্টোবর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। এ উপলক্ষে সেখানে বড় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। এতে ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীরা উপস্থিত থাকবেন।
বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আজ বিকেলে দলের যৌথ সভা হবে। তাতে দলের কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলী, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ, ঢাকার পার্শ্ববর্তী সাংগঠনিক জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা উপস্থিত থাকবেন।
দলের কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ একাধিক সূত্র জানিয়েছে, কেন্দ্রীয় কমিটির ঘোষিত কর্মসূচির পাশাপাশি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে পরিস্থিতি বুঝে বিশেষ কর্মসূচি পালন করা হবে। ঢাকা মহানগর ঘিরে বিশেষ পরিকল্পনা থাকবে আওয়ামী লীগের। প্রতিটি থানা ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীদের প্রস্তুত থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় নেতাকর্মীদের মাঠে নামতে তৈরি থাকতে বলা হয়েছে।