দেশের ইতিহাসে রেকর্ড পরিমাণ ঋণখেলাপি মানে শ্রেণিকরণ হয়েছে। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে সাড়ে ২৪ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হয়ে পড়েছে। ঋণ পরিশোধে দফায় দফায় বড় ছাড় দেয়ার পরও ঋণ ফেরত দিচ্ছে না গ্রাহকরা। মূলত অনিয়ম ও জালজালিয়াতির মাধ্যমে বিতরণকৃত ঋণ আদায় করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। তাই অর্থনীতির এ নেগেটিভ সূচকটি দিন দিন বাড়ছে।
গতকাল রোববার অনুমোদন হওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ-সংক্রান্ত হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৩ সালের জুন মাস শেষে ব্যাংক খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। খেলাপি ঋণের এ অঙ্ক দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
মহামারি করোনার প্রকোপের কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে ঋণ পরিশোধে পুরোপুরি ছাড় ছিল। গ্রাহককে ঋণ শোধ না করেও ঋণখেলাপি থেকে মুক্ত রাখার সুযোগ করে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কম সুদে ঋণ নেয়া ও ঋণ পরিশোধে কিছুটা ছাড় ছিল ২০২২ সালেও। চলতি বছরও ঋণের কিস্তির অর্ধেক পরিশোধে রয়েছে বিশেষ ছাড়। এমনসব সুযোগের পরও ব্যাংকের টাকা ফেরত দিচ্ছে না গ্রাহক। যার কারণে নানা উদ্যোগ নিয়েও খেলাপি ঋণ কমাতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এদিকে খেলাপিদের বিশেষ ছাড় বন্ধ না হলে খেলাপি ঋণ কমবে না— বলছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, ঢালাওভাবে সুবিধার কারণে ব্যাংকের পাশাপাশি গ্রাহকও বিপদে পড়বে।
তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তিন মাস আগেও মার্চ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। সে হিসেবে বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ১০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা। এছাড়া এক বছরে অর্থাৎ গত বছরের জুনের তুলনায় খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩০ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। ২০২২ সালের জুনে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি বছরের ২০ জুন জানায়, যদি কোনো গ্রাহক চলতি বছরের জুনের মধ্যে ঋণের কিস্তির অর্ধেক টাকা জমা দেয়, তবে সে খেলাপি হবে না। ফলে যারা ঋণ নিয়ে কিস্তি শোধ না করে খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছিল, তারা কিস্তির অর্ধেক টাকা জমা দিয়েই নিয়মিত গ্রাহক হওয়ার সুযোগ পায়। তবে শুধু মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে এই সুবিধা দেয়া হয়। সাধারণত ব্যবসা শুরু বা শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে মেয়াদি ঋণ নেয়া হয়ে থাকে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, খাতা-কলমে দেখানো হচ্ছে এক লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বাস্তবে এ অঙ্ক অনেক বেশি। কারণ, এখানে পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা ঋণের হিসাব নেই, এগুলো যোগ করলে আড়াই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
তিনি জানান, খেলাপি ঋণ ধারাবাহিক বাড়তে থাকা মানে ব্যাংক খাতে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হবে। এতে করে ব্যাংকগুলোর ঋণ দেয়ার সক্ষমতা কমবে। ফলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে যাবে এবং কর্মসংস্থান হ্রাস পাবে। সর্বোপরি দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে, যা আমাদের কাম্য নয়।
এখন কী করা উচিত জানতে চাইলে সাবেক এই অর্থ উপদেষ্টা বলেন, এখন সুবিধা বন্ধ করে খেলাপিদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যেন আইনে গিয়ে বছরের পর বছর না ঝুলে থাকে। এছাড়া খেলাপিদের সম্পদ নিয়ে নিতে হবে। কঠোর অবস্থায় যাওয়া ছাড়া এখন আর কোনো বিকল্প নেই বলে জানান এই অর্থনীতিবিদ।
প্রসঙ্গত, ডলার সংকটে পড়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের ঋণের দ্বারস্থ হয় বাংলাদেশ। ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭৬ দশমিক ২৭ মিলিয়ন ডলার পাওয়া গেছে। বাকি ছয় কিস্তির মধ্যে আগামী নভেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারিত আছে। ধাপে ধাপে ঋণ ছাড়ের ক্ষেত্রে সংস্থাটি ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার শর্ত দিয়েছে। ২০২৬ সালের মধ্যে বেসরকারি খাতে খেলাপি ঋণ পাঁচ শতাংশের নিচে এবং সরকারি ব্যাংকে ১০ শতাংশের নিচে নামাতে হবে। সব শেষ প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণের গড় হার ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের অন্যতম শর্ত হচ্ছে রাষ্ট্র খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা। অথচ এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।