নির্বাচনের আগে মাঠ নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় বড় দুই দলই উত্তপ্ত হচ্ছে রাজপথ

নির্বাচনের আগে মাঠ নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় বড় দুই দলই উত্তপ্ত হচ্ছে রাজপথ

এ মাসেই ঢাকায় বড় ধরনের একটি মহাসমাবেশ করবে রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি। এ মহাসমাবেশ থেকেই ঘোষণা করবে আন্দোলনের কঠোর কর্মসূচি। এর মাধ্যমে তারা রাজপথ দখলের পরিকল্পনা করছে। অপরদিকে পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে মাঠে সক্রিয় থাকবে আওয়ামী লীগও। সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মাঠে থাকতে ইতোমধ্যেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে মাঠ দখলের প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে ফের রাজপথ উত্তপ্ত হচ্ছে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র ৩ মাস বাকি। নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপ অনুসারে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হবে এ নির্বাচন। তার আগে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঘোষণা করা হবে নির্বাচনের তফসিল। তাই নির্বাচনের আগেই রাজপথ দখলের চিন্তা করছে বিএনপি। চলতি অক্টোবর মাস থেকেই আন্দোলন জোরদারের চেষ্টা করছে তারা। পূর্বঘোষিত চলমান আন্দোলন কর্মসূচি শেষে আবারও এ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত কর্মসূচি ঘোষণা করবে। এই কর্মসূচি পালনের পর তারা ঢাকায় একটি মহাসমাবেশ করে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এদিকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত বিএনপির কর্মসূচির পাল্টা কর্মসূচি ঘোষণা করে মাঠ দখলে রাখার কৌশল নিয়েছে। পূর্ব ঘোষিত চলমান কর্মসূচি পালন শেষে আবারও সিরিজ কর্মসূচি ঘোষণা করবে আওয়ামী লীগ। দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের এসব কর্মসূচিতে আরও বেশি সক্রিয় করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়।

সূত্র মতে, এ মাসের শেষের দিকে রাজধানী ঢাকায় একটি বড় ধরনের মহাসমাবেশ করবে বিএনপি। সারাদেশের সকল জেলা-উপজেলা থেকে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী ও সমর্থকের উপস্থিতি ঘটিয়ে বড় ধরনের শোডাউন করে আন্দোলনের কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করবে। এ কর্মসূচির মধ্যে ঢাকা অবরোধসহ বিভিন্ন কর্মসূচি থাকতে পারে। দলটি আশা করছে, এটিই এবারের আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট হবে।

২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর যেভাবে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচি ঘোষণা করে সারাদেশের সর্বস্তরের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ‘চলো চলো ঢাকা চলো. স্লোগান দিয়ে রাজধানীতে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন এবারও ঢাকা অবরোধের ডাক দিয়ে সেভাবে সবাইকে আসতে বলা হতে পারে। এভাবে দেশের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ঢাকায় একটি বড় ধরনের সমাবেশ করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে দাবি আদায়ের শেষ চেষ্টা করবে। তারপর পরিবেশ অনুকূল মনে করলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে। তা না হলে নির্বাচন বর্জনও করতে পারে। তবে নির্বাচনে অংশ নেবে এমনটি ধরে নিয়েই তলে তলে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে দলের নেতারা। দলীয় হাইকমান্ড থেকে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দসহ জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের আন্দোলনের পাশাপাশি নির্বাচনের প্রস্তুতিও রাখতে বলা হয়েছে।

২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতা ছাড়ার পর রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় পড়ে। এর পর ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভরাডুবি, ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে বিএনপি। দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরাজ করে হতাশা। তাই এ অবস্থার অবসান ঘটিয়ে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে রাজপথে ধারাবাহিক আন্দোলন চালিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে চলেছে। তবে এখনো রাজপথের আন্দোলনে কাক্সিক্ষত গতি আনতে পারেনি। অক্টোবরের শেষ দিকেই তারা আন্দোলনে গতি আনতে পারবে বলে দলের নেতারা আশা করছেন।

এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, দেশের সর্বস্তরের মানুষ এবং গণতান্ত্রিক সব রাজনৈতিক দলগুলো বর্তমান সরকারের পতন চায়। এ জন্য তারা রাজপথে আন্দোলনে শরিক হয়েছে। শীঘ্রই কঠোর আন্দোলন শুরু হবে এবং দেশবাসী আন্দোলনের সুফল অর্থাৎ বর্তমান সরকারের শেষ পরিণতি দেখতে পাবে।

বিএনপির কঠোর আন্দোলনের হুমকির জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, আন্দোলনের নমে নৈরাজ্য করার চেষ্টা হলে কঠোর হাতে মোকাবিলা করা হবে। আর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও ঘরে বসে থাকবে না। রাজপথে নৈরাজ্য বন্ধে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে মাঠে সক্রিয় থাকবে। আর সংবিধান অনুসরে যথাসময়ে নির্বাচন হবে।

দীর্ঘ দেড় দশক ক্ষমতার বাইরে থাকায় দলের অবস্থান ধরে রাখতে নতুন পরিকল্পনা করে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দৌড়ঝাঁপ বৃদ্ধির পাশাপাশি গত বছর ডিসেম্বর থেকে সরকারবিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা করতে ঘন ঘন কর্মসূচি পালন করতে থাকে দলটি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ডান, বাম ও মধ্যপন্থী ছোট-বড় প্রায় তিন ডজন রাজনৈতিক দলকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে। সমমনা দলগুলোকে নিয়ে বিএনপি ৯ মাসে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে যুগপৎ শতাধিক কর্মসূচি পালন করে। এর মাধ্যমে দলের নেতাকর্মীদের রাজপথের আন্দোলনে সক্রিয় করার চেষ্টা করে। অবশ্য এ আন্দোলন করতে গিয়ে ক’জন তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীকে প্রাণ দিতে হয়েছে।

গতবছর ১০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশ থেকে ১০ দফা দাবি ঘোষণা করে রাজপথে ঘন ঘন কর্মসূচি পালন করতে থাকে বিএনপি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা, সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেওয়া ও খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ ১০ দফা দাবিতে বিএনপি সমমনা দলগুলোকে নিয়ে আন্দোলনে কিছুটা অগ্রসর হলেও সরকারকে চাপে ফেলার মতো তেমন কিছু করতে পারেনি।

৬ মাসের বেশি সময় ধরে দেশব্যাপী ধারাবাহিক আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১২ জুলাই নয়াপল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বড় ধরনের সমাবেশ করে ১৮ ও ১৯ জুলাই ঢাকাসহ দেশব্যাপী ২ দিনের পদযাত্রা কর্মসূচি ঘোষণা করে। এ কর্মসূচি পালন শেষে ২২ জুলাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের তারুণ্যের সমাবেশকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের শোডাউন করে রাজধানীতে মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দেয়। এ ঘোষণা অনুসারে ২৮ জুলাই নয়াপল্টনে সারাদেশ থেকে লক্ষাধিক নেতাকর্মী ও সমর্থকের উপস্থিতি ঘটিয়ে বড় ধরনের মহাসমাবেশ করে। সমমনা দলগুলোও পৃথক অবস্থানে থেকে মহাসমাবেশ করে। এর পরদিন রাজধানীর চারদিকের প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। এর পর দফায় দফায় পদযাত্রা, গণমিছিল ও কালোপতাকা মিছিল কর্মসূচি পালন করে। এর পর সারাদেশের সকল বিভাগে রোডমার্চ কর্মসূচি ঘোষণা করে দলটি, যা ৫ অক্টোর শেষ হচ্ছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দেশে এ যাবত সরকারবিরোধী যে দল যখন রাজপথে আন্দোলন সফল করতে পেরেছে সে দলই ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের আর মাত্র ৩ মাস বাকি থাকলেও বিএনপি এখন সরকারবিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা করতে পারেনি। আর এ ৩ মাস আওয়ামী লীগসহ তাদের সমমনা দলগুলো মাঠে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় থাকলে বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো আন্দোলন তেমন জোরদার করতে পারবে কি না তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। কিন্তু বিএনপি নেতারা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা বলছেন, অতীতের আন্দোলন কি হয়েছে সেটা দেখার বিষয় নয়, এবার বিএনপির আন্দোলন সফল হবে। আন্দোলন করেই বিএনপি সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি আদায় করবে এবং দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার মুক্তি নিশ্চিত করবে। আর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে আন্দোলন করেই দল এ পর্যায়ে এসেছে। তাই আওয়ামী লীগ জানে বিএনপির আন্দোলন কিভাবে মোকাবিলা করতে হবে।

সূত্র জানায়, এ মাসের শেষ দিকে ঢাকায় যে মহাসমাবেশ হবে তা সফল করতে কেন্দ্র থেকে সারাদেশের সকল স্তরের নেতাকর্মীদের রাজধানীতে আসার নির্দেশ দেয়া হবে। এ জন্য বিএনপির ১০টি সাংগঠনিক বিভাগ, ৮২টি সাংগঠনিক জেলা ও সকল উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের উপস্থিত থাকতে বলা হবে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের চেয়ে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বেশি আগ্রহ রয়েছে বলে জানা যায়।

অভিজ্ঞ মহলের মতে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দুই বড় দলের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আবারও উত্তপ্ত হতে পারে। কারণ, বিএনপি বলছে আর বেশি সময় হাতে নেই, তাই বিএনপির এখন পেছনে ফেরার সুযোগ নেই। ২০০১ সালের আগে চারদলীয় জোট করে যেভাবে রাজপথ দখলে রেখে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয় লাভ করে এবারও সেভাবে সমমনা দলগুলোকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন করে এক দফা দাবি আদায় করার চেষ্টা করবে। তাই তারা কঠোর কর্মসূচি দিয়ে মাঠে সক্রিয় থাকলে এবং সরকারি দল আওয়ামী লীগ তা রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার জন্য পাল্টা কর্মসূচি দিলে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে।

জাতীয় রাজনীতি শীর্ষ সংবাদ