অনলাইনে জুয়ার জাল

অনলাইনে জুয়ার জাল

দেশে ছড়িয়ে পড়ছে অনলাইনকেন্দ্রিক জুয়ার জাল। অল্প সময়ে বেশি লাভের আশায় অনেক তরুণ এই নেটওয়ার্কে পা ফেলছেন। এর মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। জুয়ার সাইটগুলোর অধিকাংশ রাশিয়া, ফিলিপাইন, ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া থেকে তদারক করা হচ্ছে। অনেক তরুণ আবার দেশের বাইরে পড়াশোনা করতে গিয়ে এ জালে নিজেদের জড়াচ্ছেন। টেলিগ্রামে তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখছেন। খেলাধুলার বড় ইভেন্ট সামনে এলেও জুয়ার কারবার ধুন্ধুমার হয়ে ওঠে। এখন ক্রিকেট বিশ্বকাপ ঘিরেও অনলাইনকেন্দ্রিক জুয়া জমাট।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সংস্থা সাইবার প্যাট্রলিং জোরদার করেছে। এরই মধ্যে জুয়ার সাইট তদারকের সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন বাংলাদেশি এজেন্টকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
জুয়ার সাইটের ওপর নজর রাখেন এমন একাধিক কর্মকর্তা বলেন, অনলাইন জুয়ার খারাপ দিক হলো শুরুতে অল্প টাকা বিনিয়োগ করে লাভ পাওয়ার পর আবার যখন বেশি টাকা নিয়ে খেলা শুরু করেন, তখন সব খুইয়ে মানসিকভাবে বড় ধাক্কা খান। এটা সামলাতে না পেরে কেউ কেউ হতাশা থেকে মাদকের সঙ্গে যুক্ত হন। কেউ আবার অসৎ উপায়ে টাকা রোজগার করে ফের খেলতে শুরু করেন। এ ছাড়া জুয়ার কারবারিরা বেশির ভাগ সময় লেনদেন করেন মোবাইল ব্যাংকিংয়ে। এতে করে কোটি কোটি টাকা পাচার হচ্ছে।

বাংলাদেশে অনলাইন জুয়ার যেসব সাইট বেশি জনপ্রিয় এর মধ্যে রয়েছে– মোস্টবেট, বেট উইনার, বেট৩৬৫, ১এক্সবেট, বেটবাজ৩৬৫, ২২বেট, মেলবেট, বেটওয়ে, ক্যাসিনো, ক্রিকএক্স, লাইন বেট, মেগা পারি। সম্প্রতি পুলিশ মহাপরিদর্শকের কাছে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে সিআইডি। সেখানে উঠে আসে, এক বছরে প্রায় ২৬০ কোটি টাকা এক্সবেটের মাধ্যমে লেনদেন হয়। এ ছাড়া বেট৩৬৫-তে ২৪৫ কোটি, মোস্টবেটে ২৩০ কোটি, বেট উইনারে ১৪০ কোটি ও বেটবাজে ১৩৩ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে।

অনলাইন জুয়ার ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা অন্য কোনো অনলাইন বা ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল মাধ্যমে খেলাধুলা বা এ-সংক্রান্ত অন্য কোনো বিষয়ে বাজি ধরা হয়। বাজির লেনদেনের জন্য জুয়াড়িরা ক্যাশহীন ব্যাংকিং লেনদেন (ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড), মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেন বা বিটকয়েনসহ অন্য যে কোনো ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করতে পছন্দ করে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, অনলাইন জুয়ার খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হন হাজার হাজার মানুষ। যারা জুয়া খেলছেন, তাদের পারিবারিক বন্ধন শিথিল হওয়ার পাশাপাশি সহনশীলতা কমে যাচ্ছে। টাকা জোগাড় করতে গিয়ে করে যাচ্ছে চুরি-ছিনতাইয়ের মতো অপরাধও। আবার অনলাইন জুয়া ঘিরে খুনাখুনিও হচ্ছে। জুয়া খেলার বিস্তৃতি আরও বাড়াতে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের টার্গেট করে জুয়ার সাইটের বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে বাংলায়। অনলাইন ক্যাসিনোর অ্যাপ ইনস্টলের জন্যও দেওয়া হচ্ছে নানা অফার। এমনকি বিজ্ঞাপনে বাংলাদেশের জনপ্রিয় ক্রিকেটারদের ছবিও ব্যবহার করা হচ্ছে। সীমান্তবর্তী জেলায় বসে অনেকে নির্বিঘ্নে জুয়ার সাইট চালাচ্ছে। আবার অনেক বাংলাদেশি বিদেশি জনপ্রিয় জুয়ার সাইটের এজেন্ট হতে মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করছেন। একেকটি সাইটে লক্ষাধিক মানুষও যুক্ত থাকছেন।

সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে জুয়ার সাইট পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। তাদের মধ্যে একজন মতিউর রহমান। তিনি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ ও আদালতে ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে বাংলাদেশকেন্দ্রিক অনলাইন জুয়ার কারবার নিয়ে বিস্তারিত তথ্য দেন। মতিউরের ভাষ্যে উঠে আসে, ২০১৭ সালে রাজধানীর পলিটেকনিক কলেজ থেকে ডিপ্লোমা শেষ করে বৃত্তি নিয়ে রাশিয়া পড়তে যান। মস্কোতে লেখাপড়ার পাশাপাশি পার্টটাইম কাজ করতেন মতিউর। ২০২১ সালে রাশিয়ায় আফগানিস্তানের নাগরিক জায়নুল্লাহর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। ‘বেট উইনার’ সাইট এবং কীভাবে এজেন্ট জুয়ার কারবার করে অল্প সময়ে লাখ লাখ টাকা আয় করা সম্ভব, সে বিষয়ে ছবক দেন জায়নুল্লাহ। এর পর জুয়ার কয়েকটি সাইটের এজেন্ট হতে ই-মেইলের মাধ্যমে আবেদন করেন মতিউর। এসব ই-মেইল নম্বর অনলাইনে দেওয়া ছিল। তখন সাইট পরিচালনাকারীরা তাঁর কাছে বাংলাদেশি বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং নম্বর চায়। রাশিয়াতে থাকার কারণে মতিউরের পক্ষে মোবাইল ব্যাংকিং নম্বর দেওয়া সম্ভব হয়নি। এ নম্বরের জন্য তাঁর পূর্বপরিচিত গাইবান্ধার সৈকত রহমানের সহযোগিতা নেন। সৈকত ও মতিউর রহমান মিলে শুরু করেন জুয়ার কারবার। পরে তাদের সঙ্গে যুক্ত হন আরও কয়েক বাংলাদেশি। তারা হলেন রেজাউল করিম রানা ও সাদিকুল ইসলাম। এজেন্ট হিসেবে কমিশন পেতেন মতিউর। লাভের টাকা অন্যদের মধ্যে ভাগ করে দিতেন তিনি। শুরুতে প্রতি মাসে একেকটি সাইট থেকে দেড় লাখ টাকার মতো আয় হতো। পরে ধীরে ধীরে আয় বাড়তে থাকে। শুরুতে পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন তারা।

পুলিশ জানায়, সম্প্রতি চুয়াডাঙ্গায় ৫০ জন মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টের তথ্য পাওয়া গেছে। ওই নম্বরগুলো থেকে অনলাইন জুয়ার টাকা লেনদেন হচ্ছে। এ নম্বরের কয়েকটি থেকে দিনে ১০ লাখের ওপর টাকা লেনদেন করছে জুয়াড়ি চক্র। পরে এ টাকা হুন্ডি বা অবৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলে পাচার হয়। অনলাইন জুয়ার একেকটি আলাদা বেটিং সাইট বা ওয়েবসাইট রয়েছে। এসব ওয়েবসাইটে ঢুকে প্রথমে নিবন্ধন করে জুয়াড়িরা। এরপর তারা ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড পায়। সাইটে যুক্ত হওয়ার বিভিন্ন ধরনের লটারি রয়েছে, যেগুলোতে পছন্দ অনুযায়ী অ্যাকাউন্ট হোল্ডার খেলতে পারে। এ ক্ষেত্রে অ্যাকাউন্টধারী ব্যক্তি জিতলে অ্যাকাউন্টে ব্যালান্স জমা হবে। আর হেরে গেলে টাকা চলে যাবে। আমাদের দেশে অনলাইন-অফলাইন সব ধরনের জুয়ার ফরমেটই নিষিদ্ধ। সিআইডি বলছে, যারা বেশি এজেন্ট নিয়ে বাংলাদেশে এ কারবার করছে, তাদের পাঁচজনকে শনাক্ত করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের বিশেষ সুপার রেজাউল মাসুদ বলেন, স্মার্টফোন ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সহজলভ্যতার সুযোগ নিয়ে অনেক চক্র অনলাইন জুয়ার কারবার ছড়িয়ে দিচ্ছে। আমরা নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি নিয়মিত গ্রেপ্তার অভিযান চালাচ্ছি।

তথ্য প্রুযুক্তি শীর্ষ সংবাদ