রেমিট্যান্স প্রবাহে ব্যাপক ধস নামার প্রেক্ষাপটে রেমিট্যান্স সংগ্রহের ক্ষেত্রে কৌশলে কিছুটা নমনীয়তা দেখাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ঘোষিত দরের চেয়ে অতিরিক্ত দরে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে অনেক ব্যাংক। এ ক্ষেত্রে ক্রস কারেন্সি বা তৃতীয় মুদ্রায় রূপান্তরের ক্ষেত্রে শিথিলতা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ সুযোগে বড় গ্রাহকরা বাড়তি দামে ডলার সংগ্রহ করায় ছোট ব্যবসায়ীরা ডলার পাচ্ছেন না। একইসঙ্গে ডলার বাজারে অদৃশ্য চাপ তৈরি হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যখন বাজারে একাধিক দর প্রচলন শুরু হয়, তখন অস্থিরতা বিরাজ করবে— এটাই স্বাভাবিক।
গত সেপ্টেম্বরে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সে বড় ধরনের ধাক্কা লাগে। ওই মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ৬০ হাজার ডলার। এটি গত ৪০ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০২০ সালের এপ্রিলে এসেছিল ১০৯ কোটি ২৯ লাখ ৬০ হাজার ডলার। এরপর সেপ্টেম্বরের আগে আর কোনো মাসে এত কম রেমিট্যান্স আসেনি। তবে চলতি অক্টোবর মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহ উল্লেখযোগ্য হারে না বাড়লেও আগের মাসের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। ব্যাংকগুলোর বেশি দামে রেমিট্যান্স সংগ্রহের প্রেক্ষাপটে চলতি মাসের প্রথম ১৩ দিনে ৭৮ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। আগের মাস সেপ্টেম্বরের প্রথম ১৫ দিনে এসেছিল ৭৪ কোটি ডলার। জানা গেছে, গত রবি ও সোমবার কয়েকটি ব্যাংক নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে রেমিট্যান্স সংগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। গতকালও এ ধারা অব্যাহত ছিল। রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ তৈরি হওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকেও ছাড় দেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা। তবে পরোক্ষভাবে এ ছাড় দেয়ার কথা নিশ্চিত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র।
সূত্রের তথ্যমতে, এবিবি ও বাফেদা নির্ধারিত দাম অনুযায়ী রেমিট্যান্স সংগ্রহের বিষয়ে কোনো ছাড় দেয়া হচ্ছে না। তবে ক্রস কারেন্সি বা তৃতীয় মুদ্রায় রূপান্তরের ক্ষেত্রে ডলার মূল্যকে ভিত্তি ধরে লেনদেন করতে বলা হয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে মুদ্রা পরিবর্তনের মাধ্যমে বেশি দামে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে ব্যাংকগুলো। স্বাভাবিক কারণেই বেশি দামে ক্রয় করা মুদ্রা বিক্রিও হচ্ছে বেশি দামে। ফলে বাজারে ঘোষিত দরের চেয়ে অনানুষ্ঠানিক দর প্রাধান্য পাচ্ছে। নাম প্রকাশ না করে ডলার কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত একজন ব্যাংকার বলেন, যখন বেশি দামে রেমিট্যান্স কেনা হয়, তখন আমদানিকারকদের কাছেও বেশি দামে বিক্রি করতে হয়। অনেক আমদানিকারক আছেন, তারা যে কোনো মূল্যে ডলার চান। তখন বেশি দামে কিনে হলেও তাদের চাহিদা পূরণ করতে হয়। অন্যথায় কাস্টমার ধরে রাখা যায় না। এক্ষেত্রে বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নিতে হয় বলে জানান এ ব্যাংকার। এমন পরিস্থিতির কারণে বিপাকে পড়ছেন ছোট ব্যবসায়ীরা। এলসি খুলতে গিয়ে তারা ডলার পাচ্ছেন না। আবার ডলার পেলেও দাম বেশি হওয়ায় লোকসান গুনতে হচ্ছে। কারণ, ব্যাংকগুলোর ঘোষিত দর হিসাবে ধরেই ব্যবসায়িক চুক্তি ঠিক করা হয়। কিন্তু যখন হঠাৎ দাম ৭-৮ টাকা বেড়ে যায়, তখন বড় লোকসান গুনতে হয়।
ডলার বাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ব্যাংকগুলো এখন নিজেরাই নিজেদের সিদ্ধান্ত মানছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরোক্ষ নির্দেশনায় ব্যাংকগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রেমিট্যান্স সংগ্রহ করতে সর্বোচ্চ ব্যয় করবে প্রতি ডলারে ১১০ টাকা। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত এখন নিজেরাই অমান্য করে ১১৩ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১১৮ টাকা পর্যন্ত মূল্যে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে কেউ কেউ। স্বাভাবিক কারণেই ১১৮ টাকা মূল্যে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করে ১২০ টাকার কম-বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। ডলার বিক্রির ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আমদানিকারকদের কাছে ডলার বিক্রি করা হবে সর্বোচ্চ ১১০ টাকা ৫০ পয়সা দরে। কিন্তু এ সিদ্ধান্তও অনেকেই মানছে না। তবে সরাসরি বেশি দাম না নিয়ে কখনো কর্পোরেট ডিলিংসের নামে, আবার কখনো অগ্রিম ডলার বিক্রির নামে বাড়তি প্রিমিয়াম নিচ্ছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, রেমিট্যান্সের ডলারের মূল্য নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কোনো শিথিলতা দেয়া হয়নি। কিন্তু কেউ যদি বেশি দামে ডলার আনে, তাহলে এটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। তারা লোকসান দিয়ে কম দামে ডলার বিক্রি করবে। তিনি বলেন, কেউ বেশি দামে ডলার বিক্রি করছে কি না, সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে। কেউ যদি আমদানিকারকের কাছ থেকে অতিরিক্ত দাম নেয়, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো ধরনের শিথিলতা দেখাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ডলারের মূল্য নিয়ে কোনো শিথিলতা দেয়া হয়নি। শুধু ডলার থেকে অন্য মুদ্রায় রূপান্তের ক্ষেত্রে শিথিলতা দেয়া হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে অবশ্যই ডলারের আন্তঃব্যাংকের মূল্যকেই ভিত্তি ধরে করতে হবে। যেমন, দিনের বিভিন্ন সময় ইউরোর মূল্য ওঠানামা করতে পারে। এ ক্ষেত্রে ডলারের আন্তঃমূল্য ১১০ টাকা ৫০ পয়সাকে ভিত্তি ধরে ইউরোর মূল্য রূপান্তর করতে পারবে ব্যাংকগুলো।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বাফেদা রেমিট্যান্সের ডলারের অভিন্ন মূল্য নির্ধারণ করলেও এ মূল্য কেউই মানছে না। যারা নিয়ম মানতে যাচ্ছে, তারাই পড়ছে বেকায়দায়। কারণ, একজন নিয়ম মেনে ১১০ টাকা দরে রেমিট্যান্স আনছে; কিন্তু অন্য ব্যাংক দিচ্ছে ১১৮ টাকা। ফলে নিয়ম মানতে গিয়ে তার ব্যাংক রেমিট্যান্স সংগ্রহ করতে পারছে না। এ দিকে গ্রাহকের পণ্য আমদানিতে ডলার সরবরাহ করতে না পারলে অন্য ব্যাংকে চলে যাচ্ছে। বেশি দামে ডলার এনে কীভাবে কম দামে বিক্রি করছে— এমন প্রশ্নে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, তারা বেশি দামে ডলার কিনে নানা কৌশলে বেশি দামে বিক্রি করছে। তবে সরাসরি বেশি দামে বিক্রি না করে কর্পোরেট ডিলিংস বা আগাম ডলার বুকিংয়ের নামে বেশি দাম নিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে রিপোর্ট করছে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। কিন্তু এর সঙ্গে ১০ শতাংশ বাড়তি প্রিমিয়াম নিয়ে ১২৩ টাকা পর্যন্ত ডলার বিক্রি করছে।
মুদ্রাবাজারে এ অস্থিরতার কারণে নিয়ম মেনে চলা ব্যাংকগুলো পড়েছে বেকায়দায়। তারা কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ রেমিট্যান্স সংগ্রহ করতে না পারায় গ্রাহক ধরে রাখতে পারছে না। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককেই আরও শক্ত অবস্থান নিতে হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য বেশি দামে ডলার কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন এমডি বলেন, ‘বেশি দরে রেমিট্যান্স কিনলে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসীরা অর্থ পাঠাবেন। এতে হুন্ডির প্রভাব কমবে। কিন্তু এটি সর্বজনীন না করলে বাজার ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। তাই মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়।’