শেখ হাসিনার প্রথম স্বপ্ন ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ। এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশ আজ সারা বিশ্বে এক অনন্য উচ্চতায় সমাসীন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ না করতেন তবে করোনা অতিমারির বিপর্যয়ের সময় বাংলাদেশের আরও বহু মানুষ মৃত্যুবরণ করত এবং দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাও আরও শোচনীয় হতো। তার সুদক্ষ নেতৃত্বের কারণেই অতিমারির সময় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অনেক উন্নত দেশের মতো খারাপ অবস্থায় পতিত হয়নি। অথচ আমরা দেখেছি বিশ্বের অনেক ধনী দেশেও তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব নাজুক হয়ে পড়েছিল। আবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবেও বাংলাদেশ খুব সাহসের সঙ্গেই অর্থনৈতিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাই তার সুদক্ষ নেতৃত্বের জন্য বিশ্বের অনেক দেশের কাছেই অনুসরণীয় মহীয়সী নেত্রী।
২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ঘোষণা করেন। তার আগে বিশ্বের কোনো দেশ পুরো দেশটাকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে বদলে দেয়ার কথা চিন্তায় আনেনি। বাংলাদেশের পর ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে ব্রিটেন এবং ২০১৪ সালের ১৫ আগস্ট ভারত আমাদের পথ অনুসরণ করে। আবার ২০১১ সালে জার্মানি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কথা ভাবে এবং ২০১৬ সালে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম চতুর্থ বিপ্লবের ঘোষণা দেয়। অবশ্য জাপান কোরিয়া বহুদিন থেকেই ইউবিকুটাস দেশ হিসেবে তাদের গড়ে তোলার কথা বলে আসছিল এবং শ্রীলঙ্কা ও রুয়ান্ডা ই-লঙ্কা ই-রুয়ান্ডা স্লোগান দিয়ে আসছিল; কিন্তু ডিজিটাল যুগের প্রকৃত আপ্ত বাক্যটি তারা কেউ উচ্চারণ করেনি। অথচ শেখ হাসিনা রূপকল্প-২০২১: ডিজিটাল বাংলাদেশ, এসডিজি-২০৩০, স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১, ২১০০ সালের বাংলাদেশ: ডেলটা প্ল্যান বাস্তবায়নের কথা ঘোষণা করেছেন।
প্রসঙ্গ: ডিজিটাল বাংলাদেশ
এই ডিজিটাল বাংলাদেশ স্বপ্ন অর্থাৎ রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নে সরকারের সচিব হিসেবে একজন প্রত্যক্ষ শ্রমিক ছিলাম আমি। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে কাজ শুরু করেছিলাম তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগে। পরে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে কাজ করি একই মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে। এ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনকালে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল শেখ হাসিনাকে খুব কাছ থেকে দেখার এবং তারই নির্দেশনা নিয়ে আমাদের স্বপ্নযাত্রায় সব কাজ করার। তার প্রখর মেধা ও দৃঢ় ব্যক্তিত্ব এবং দেশপ্রেমের উজ্জ্বল অগ্রগামীতায় প্রগাঢ় ভালোবাসায় যেসব সিদ্ধান্ত তিনি দিয়েছেন, তা প্রত্যক্ষ করে বারবার শুধু অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেছি যেন তার মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর এক প্রতিচ্ছবি।
দুই বিভাগেই ব্যাপক কাজের প্রত্যক্ষ কর্মী হওয়ার আনন্দ আমার কম নয়। আইসিটি ডিভিশনে কাজের অভিজ্ঞতা আগে বলি, যেমন- প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ ইউনিয়ন পর্যন্ত ডিজিটাল কানেক্টিভিটি স্থাপন, ডিজিটাল সেন্টার (তথ্য সেবা কেন্দ্র) স্থাপন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব ও মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন, বিশ্ববিদ্যালয়ে আইটি ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন এবং বিশেষায়িত ল্যাব স্থাপন, কালিয়াকৈরে হাইটেক পার্ক স্থাপন এবং ফোর টিয়ার ডাটা সেন্টার স্থাপন, যশোর সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক স্থাপন, সরকারি অফিসগুলোতে ভিডিও কনফারেন্স সিস্টেম স্থাপন, দেশের বিভিন্ন জায়গায় আইটি পার্ক নির্মাণ, শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং সেন্টার নির্মাণ, আইসিটি টাওয়ারে সাইবার সিকিউরিটি অপারেশন সেন্টার স্থাপন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যবইয়ের ডিজিটাল কন্টেন্ট তৈরি এবং বিভিন্ন আইটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বাস্তবায়নকালে আমি ছিলাম আইসিটি ডিভিশনের সচিব।
ডিজিটাল কানেক্টিভিটির জন্য যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয় সেগুলোর মধ্যে আইসিটি ডিভিশনের বাংলা গভনেট প্রকল্প, ইনফো সরকার-২ প্রকল্প, ইনফো সরকার-৩ প্রকল্প উল্লেখযোগ্য। প্রথম প্রকল্পটির মাধ্যমে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সেগুলোর আওতাধীন দুইশতাধিক সরকারি অধিদপ্তর/ সংস্থা এবং ৬৪ জেলা ও ৬৪ সদর উপজেলা কানেক্ট করা হয়। দ্বিতীয় প্রকল্পের মাধ্যমে সব জেলা ও উপজেলার সব সরকারি অফিস, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, পিটিআইগুলো কানেক্ট করা হয়। এতে ১৮,৪০০ সরকারি অফিস কানেক্ট করে রাজধানীর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স করার পদ্ধতি চালু করা হয়। এ ছাড়া ২৫,০০০ সরকারি কর্মকর্তার কাছে ট্যাবলেট পিসি দেয়া হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল সরকারি অফিসের কাজগুলো ডিজিটাল পদ্ধতিতে সম্পন্ন করা। আর তৃতীয় প্রকল্প দিয়ে দেশের ২৬০০ ইউনিয়নকে কানেক্ট করা হয়। এর বাইরে আরও প্রায় ১২০০ ইউনিয়নের কানেক্টিভিটি স্থাপনের কাজ সম্পন্ন করেছে বিটিসিএল। এ ছাড়া এখন আরও ৬১৭টি ইউনিয়নকে কানেক্ট করার জন্য বিটিআরসির এসওএফ তহবিল দিয়ে প্রকল্প চলমান রয়েছে।
পাশাপাশি এটুআই সরকারি অফিসে ই-নথি চালু করার জন্য এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে সরকারি সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য প্রশংসনীয় অবদান রেখেছে। উল্লেখ্য, এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নে সামগ্রিক পরিকল্পনা ও দিকনির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য পুত্র আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়।
এবার ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে কাজের অভিজ্ঞতা বলি। এ বিভাগের অধীনে দেশের দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবল লাইনের (ঝঊঅ গঊ ডঊ ৫) সংযোগ স্থাপন, ৮৫০০ ডাকঘরকে ই-পোস্ট অফিসে রূপান্তরকরণ, পোস্টাল ক্যাশকার্ড সার্ভিস প্রবর্তন, ফোর জি চালুকরণ, মোবাইল সিম রেজিস্ট্রেনের ঈইঠগচ চালুকরণ, মোবাইল ফাইনান্সিং সার্ভিসের জন্য ‘নগদ’ চালুকরণ এবং সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ ইত্যাদি যুগান্তকারী ডিজিটাইজেশন দেশে বিস্তার লাভ করেছে এবং আমার সুযোগ হয়েছে এসব কাজে সংশ্লিষ্ট থাকার।
দেশে টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদানের কাজে ভূমিকা রাখার জন্য বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) গঠন করা হয়েছিল ২০০২ সালে। বিটিআরসি মূলত ডিজিটাল সেবা প্রদানের জন্য মহাসড়ক অর্থাৎ অবকাঠামো তৈরি ও নিয়ন্ত্রণ কাজ করে থাকে। এ জন্য বিটিআরসির অধীনে প্রায় ৩৮০০ লাইসেন্স গ্রহীতা আছে।
এদের মধ্যে মোবাইল অপারেটর, এনটিটিএন অপারেটর, আইজিডব্লিউও, আইআইজি, আইএসপি, আইপিটিএসপি এবং অন্য অপারেটররা রয়েছে। তবে শুধু ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার রয়েছে ২৯০০-এর অধিক।
আর এখন চলমান আছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ নির্মাণের কাজ এবং দেশের তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবল লাইন (ঝঊঅ গঊ ডঊ ৬) সংযোগের কাজ চলমান রয়েছে। অবশ্যই এসব কাজে অন্য সহকর্মীদের অকুণ্ঠ অবদানের কথাও স্বীকার করতে হবে। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এখন আর কোনো স্বপ্ন নয়, নিরেট বাস্তবতা। আমি এই যুগান্তকারী উত্তরণের এক কতা অংশীদার বলেই গর্ববোধ করতে পারি।
ডিজিটাল বাংলাদেশ স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয় সেই ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে। এই ডিজিটাল বাংলাদেশ অভিযাত্রায় মূল দায়িত্ব পালন করেছে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের এটুআই প্রকল্প। কাজেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে খুব কাছ থেকে যারা সরাসরি সহযোগিতা করেছেন সকলেই ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবেন। তাদেরও নিশ্চয়ই এ জন্য গর্ব হয়, অহঙ্কার হয় মনে মনে।
স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ প্রসঙ্গ
আমরা বিশেষ একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্যের মাইলফলক ছুঁয়েছিলাম ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট আকাশে উড়িয়ে। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের কাজটি মূলত ডিজিটাল বাংলাদেশ অভিযাত্রারই অংশ ছিল বলা যায়, স্যাটেলাইট প্রকল্পের সেই ইতিহাস পরে বলছি।
আমি বলি যে, বড় ভাগ্য নিয়েই হয়তো জন্মেছিলাম বাংলাদেশে। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এইটুকু ঋণ স্বীকার করতেই হয় যে, তিনিই আমাকে ওই কাজে নিয়োজিত করে অবদান রাখার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। আমিও যথেষ্ট আন্তরিকতা দিয়েই সেই সুযোগে দেশের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিলাম। তবে এখানে অবশ্যই উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এসব প্রযুক্তি বাংলাদেশে চালু করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ছিলেন প্রধান আর্কিটেক্ট। তিনি সব সময় এসব বিষয়ে কারিগরি দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। সুতরাং ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা হলেন শেখ হাসিনা আর সেটা বাস্তবায়নের আর্কিটেক্ট হলেন তারই সুযোগ্য পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। মূলত তিনিই ছিলেন শুরু থেকে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তির এই পাহাড়সম অগ্রগতির নেপথ্য নায়ক; কিন্তু এখানে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতার কথা না বললে ইতিহাস অসম্পন্ন থাকবে। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাঙামাটির বেতবুনিয়াতে উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র উদ্বোধন করেছিলেন। সেই ভূ-কেন্দ্র আমরা এখন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর ল্যান্ডিং স্টেশন হিসেবে ব্যবহার করছি। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু সেই সময়েই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের চিন্তা করে ওই উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন। সুতরাং সহজেই বোঝা যায় বঙ্গবন্ধু কতটুকু বিজ্ঞান মনষ্ক ও দূরদর্শী নেতা ছিলেন। অথচ দুর্ভাগ্য আমাদের বেতবুনিয়াতে ওই ভূ-কেন্দ্র উদ্বোধনের মাত্র দুই মাসের মাথায় তাকে হন্তারকদের হাতে জীবন দিতে হলো।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে আমি প্রকৃতপক্ষে কাজ শুরু করি ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ মার্চ থেকে। স্যাটেলাইট নির্মাণ প্রকল্পটি ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের আওতাধীন ছিল। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) ওপর। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি কৃত্রিম উপগ্রহ নির্মাণ বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করে। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালায় রাষ্ট্রীয় কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণের বিষয়টি যুক্ত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে বাংলাদেশের নিজস্ব কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণের জন্য আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিটের (আইটিইউ) কাছে আবেদন করে বাংলাদেশ। কৃত্রিম উপগ্রহের নকশা তৈরির জন্য ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের মার্চে প্রকল্পের মূল পরামর্শক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘স্পেস পার্টনারশিপ ইন্টারন্যাশনাল’কে (ঝচও) নিয়োগ দেয়া হয়।
কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বাংলাদেশে সম্প্রচার ও টেলিযোগাযোগ সেবা পরিচালনার জন্য ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বরে একনেক সভায় দুই হাজার ৯৬৮ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে বরাদ্দ দেয়া হয় এক হাজার ৩১৫ কোটি ৫১ লাখ টাকা, যা মোট ব্যয়ের প্রায় ৪৪ শতাংশ। এ ছাড়া ‘বিডার্স ফাইন্যান্সিং’ এর মাধ্যমে এ প্রকল্পের জন্য এক হাজার ৬৫২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা সংগ্রহের পরিকল্পনা নেয়া হয়।
মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে নির্ধারিত পদ্ধতিতে স্যাটেলাইট সিস্টেম কিনতে ফ্রান্সের কোম্পানি থ্যালাস অ্যালেনিয়া স্পেসের সঙ্গে এক হাজার ৯৫১ কোটি ৭৫ লাখ ৩৪ হাজার টাকার চুক্তি করে বিটিআরসি। অন্যদিকে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে বিটিআরসি রাশিয়ার উপগ্রহ কোম্পানি ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে কক্ষপথ কেনার আনুষ্ঠানিক চুক্তি করা হয়। এর অর্থমূল্য ছিল ২১৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা।
২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে আমি সচিব থাকার সময়ে ‘বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড’ নামে একটি সংস্থা গঠন করি কৃত্রিম উপগ্রহের সার্বিক ব্যবস্থাপনার জন্য। এই কোম্পানি সংস্থাটি আরও আগেই গঠন করার কথা ছিল। যা হোক, শেষ পর্যন্ত খুব দ্রুততার সঙ্গেই এটি গঠন করা হয়।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা এবং স্মার্ট বাংলাদেশ
ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ ও বিটিআরসি ২০১৮ সালে আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের নির্দেশে বাংলাদেশে প্রথম ৫জি প্রযুক্তির টেস্ট করেছে এবং ২০২১ সালে পরীক্ষামূলকভাবে ৫জি চালু করেছে। তবে ৫জি প্রযুক্তি বিকাশের জন্য এর সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয় জরুরি বিবেচনায় নিতে হবে। ৫জি প্রযুক্তির সাথে সম্পৃক্ত প্রযুক্তিগুলোর সঙ্গে আমাদের খুব একটা পরিচয় নেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স, বিগ ডাটা, ব্লক চেইন, আইওটিসহ ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির কোনোটাতেই আমরা তেমন এগিয়ে নেই। ৫জি শুধু কথা বলার বা ফেসবুক চালানোর প্রযুক্তি নয়। এটি মূলত শিল্প বিপ্লবের হাতিয়ার। তাই এটি শিল্প ব্যবসা-বাণিজ্য কৃষি স্বাস্থ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে অটোমেশনের কাজে ব্যবহার করতে হবে। এগুলোর জন্য সরকারের উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগ অতি প্রয়োজন। আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশ: রূপকল্প ২০২১ অর্থাৎ মধ্যম আয়ের দেশ তথা উন্নয়নশীল বাংলাদেশ বিনির্মাণ করে এখন আমরা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আরও এগিয়ে যাচ্ছি উন্নত বাংলাদেশের দিকে তথা স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১ স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে। এর মধ্যবর্তী সময়কালে আবার জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি অর্জনের কাজও সম্পন্ন হবে।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম স্বীকার করছে যে, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব এতটাই যান্ত্রিক যে মানুষের জন্য সেটি বিপজ্জনক হতে পারে। মানুষের কর্মচ্যুতির পাশাপাশি প্রযুক্তির দাপট এমনভাবে সম্প্রসারিত হরে পারে যে, মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রায় মানুষ একটু থমকে দাঁড়াতেই পারে। তবে ওই ফোরাম পঞ্চম শিল্প বিপ্লবকে মানবিক বলেছে। কারণ পঞ্চম শিল্প বিপ্লব প্রযুক্তিকে মানুষের স্থলাভিষিক্ত না করে মানুষের জন্য প্রযুক্তিকে ব্যবহার করবে। জাপান ফেডারেশন অব বিজনেস এর রূপরেখা অনুসারে সোসাইটি ৫.০ এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে- অর্থনীতি থেকে শুরু করে জাপান সমাজের সব স্তরকে ডিজিটাল করার মাধ্যমে পুরো সমাজকে রূপান্তর করা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষিত ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা ভাবলে লক্ষ্য করা যায়, আমাদের লক্ষ্যও তাদের চেয়ে অনেক বেশি সম্প্রসারিত। তবে সেখানে কিছু পার্থক্যতো থাকবেই। জাপানের পঞ্চম সোসাইটির প্রেক্ষাপটে কেইদারেনের রূপরেখায় ৫টি পর্যায়ের সোসাইটির কথা বলা হয়েছে: ১) শিকারি সমাজ, ২) কৃষি সমাজ, ৩) শিল্প সমাজ, ৪) তথ্য সমাজ এবং ৫) সুপার স্মার্ট সমাজ বা সোসাইটি ৫.০।
জাপান চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে অংশ নিতে শুরু করায় তার সমাজ ও উৎপাদন ব্যবস্থায় কৃত্রিম বুদ্ধি, রোবোটিক্স, আইওটি, বিগ ডাটা ইত্যাদি প্রযুক্তি দেশটির রূপান্তরে একটি নতুন ভূমিকা পালন করছে এবং শিল্প উৎপাদন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনছে। কাজেই স্মার্ট বাংলাদেশ কৌশল ও কর্মসূচি প্রণয়নে আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশ, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, পঞ্চম শিল্প বিপ্লব ও সোসাইটি ৫.০ এর সামগ্রিক বিষয়াদির পাশাপাশি এসডিজি লক্ষ্যমাত্রার কথাও মনে রাখতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ২০৪১ সালে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তার সেই ঘোষণার সঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বা আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি থেকে সাম্য সমাজ প্রতিষ্ঠার কর্মসূচিটি গ্রহণের একটি সার্বজনীন দিক লক্ষণীয়। তা হলো দেশের সব মানুষকে সম্পৃক্ত করে সরকার শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, কৃষি ও জীবনধারার সম্মিলিত রূপান্তর করে এই সমাজ গড়তে হবে, যার লক্ষ্য ডিজিটাল প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল সমাজ।
ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন সফলভাবে বাস্তবায়নের পর আমরা এখন সেই নতুন কর্মসূচি নিয়ে সামনের দিকে যাচ্ছি। এই কর্মসূচির নাম ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১’। এটি শেখ হাসিনার দ্বিতীয় স্বপ্ন-বাংলাদেশকে উন্নত বাংলাদেশ বানানোর জন্য। এ কর্মসূচির চারটি স্তম্ভ: স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট সোসাইটি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট, স্মার্ট ইকোনোমি। সুতরাং ২০৪১ সালে বাংলাদেশ হবে একটি সাশ্রয়ী, টেকসই, বুদ্ধিদীপ্ত, জ্ঞানভিত্তিক, উদ্ভাবনী স্মার্ট বাংলাদেশ। তবে এখন আমাদের কাঙ্ক্ষিক্ত সৃজনশীল জ্ঞানভিত্তিক ডিজিটাল অর্থনীতির প্রাথমিক বিকাশ ঘটাতে কাজ করতে হবে। শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে ডিজিটার যুগের উপযোগী মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং উচ্চশিক্ষার পাঠ্যক্রম-পাঠদানসহ পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকে ডিজিটাল যুগের উপযোগী করতে হবে। কারণ স্মার্ট সিটিজেন তৈরি করতে হবে আগে। ডিজিটাল দক্ষতাসম্পন্ন মানবসম্পদ তৈরি করে বিদেশে পাঠাতে পারলে প্রচুর ফরেন কারেন্সিও পাওয়া যাবে।
স্মার্ট গভর্নমেন্ট ও স্মার্ট ইকোনোমি
স্মার্ট গভর্নমেন্ট ও স্মার্ট ইকোনোমিতে রূপান্তরের জন্য আমাদের সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে নীতি নির্ধারণে ও পরিকল্পনায় যেতে কিছু বিষয়ের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। যেমন – ক) সব ক্ষেত্রে ক্যাশলেস লেনদেনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ, খ) সব খাতের ব্যবস্থাপনা ডিজিটাল করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ, গ) উৎপাদনের সব স্তরে ডিজিটাল প্রযুক্তি প্রয়োগ অর্থাৎ অটোমেশন করা, ঘ) সর্বত্র ডিজিটাল প্রশিক্ষণ চালুকরণ, ঙ) সৃজনশীল ও উদ্ভাবন পদ্ধতির জন্য কাজ করা, চ) শিক্ষা, কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, স্বাস্থ্য, প্রশাসন খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে ডিজিটাল করা, ছ) আইন-আদালত, সালিশ, সরকারি সেবা, হাটবাজার, জলমহাল, ভূমি ব্যবস্থাপনাসহ সব কর্মকাণ্ড ডিজিটাল করা, জ) মেধাশিল্প, সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন ও সেবা খাতকে প্রাধান্য দিয়ে শিল্প নীতি তৈরি করা, ঝ) দেশের সব আইনকে জ্ঞানভিত্তিক সমাজের উপযোগী করা, ঞ) সর্বোপরি ডিজিটাল নিরাপত্তাকে সর্বোত্তম গুরুত্ব দিয়ে তার নিশ্চয়তার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।
২০৪১ সালে স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্য হলো: জ্ঞানভিত্তিক ডিজিটাল সাম্যসমাজ গঠনের মাধ্যমে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা। আর তার কর্মসূচির আওতায় রাখতে হবে ১) পেপারলেস সভ্যতা, ২) ডিজিটাল প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল সভ্যতা, ৩) ডিজিটাল নিরাপত্তা ও ডিজিটাল যুদ্ধ, ৪) ডিজিটাল সংযুক্তি, ৫) মাতৃভাষার বিশ্ব এবং ৬) সাম্য সমাজ। ইতোমধ্যেই আমাদের কৃষি, ভূমি, স্বাস্থ্য খাতে কিছু ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করা হয়েছে। তবে এখন দরকার দক্ষতা ও গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য মনোযোগ দেয়া। সম্ভাব্য সব ক্ষেত্রে অটোমেশন করতে হবে। বিদ্যমান সব ডিজিটাল নীতিমালা ও গাইডলাইনগুলো যুগোপযোগী করে তৈরি করতে হবে, যাতে ৫জি প্রযুক্তি প্রয়োগের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়।
প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী চিন্তার ফলাফল হলো আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট -১ প্রাপ্তি। তিনি বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে বাংলাদেশের মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছেন। যেমন করে তিনি অসাধ্য সাধন করেছেন পদ্মা সেতু নির্মাণ করেও। কাজেই এমন একজন দেশপ্রেমিক মানুষ ও ‘মানবতার জননী’ খ্যাত প্রধানমন্ত্রী এখন বিশ্বের অনেক নেতার কাছেই অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। প্রশ্ন আসতে পারে, স্মার্ট বাংলাদেশের পর কি বাংলাদেশ থেমে থাকবে? না, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তারপরের কর্মসূচিও তৈরি করে দিয়েছেন। তা হলো ২১০০ সালের বাংলাদেশের জন্য ডেল্টাপ্ল্যান। সুতরাং শেখ হাসিনার মতো এমন একজন দূরদর্শী দেশনেত্রী প্রধানমন্ত্রী পেয়ে আমরা গর্বিত ও ধন্য। আমরা বাঙালিরা তাকে নিয়ে অহঙ্কার করতেই পারি।