দেশে চলমান ডলার সংকটের নেপথ্যে রয়েছে ব্যবসায়ীদের কারসাজি। তারা এক দিকে যেমন রপ্তানি আয় দেশে আনছেন না, আবার পণ্যের দাম কমবেশি দেখিয়ে বিদেশে অর্থ পাচার করছেন। এসব বিষয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গতকাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ-এবিবির সঙ্গে বৈঠক করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ডলার বাজারে অস্থিরতা, ঊর্ধ্ব মূল্যস্ফীতি এবং ব্যাংক ঋণের সুদ হার নিয়ে চলমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় করণীয় ঠিক করতে এ বৈঠকের আয়োজন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে অর্থনীতির নীতিগত যে পরিবর্তন আনা হয়েছে সেগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য তাগিদ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ডলার সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে দিকনির্দেশনার পাশাপাশি সৃষ্ট সমস্যাগুলো সম্পর্কে এমডিদের ধারণা দেয়া হয়েছে।
এ সময় চলমান সংকটের জন্য ব্যবসায়ীদের দায়ী করে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে সে পরিমাণ ডলার দেশে আসছে না; বরং পণ্যমূল্য পরিশোধের জন্য সময় বাড়িয়ে দিচ্ছেন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা। ফলে বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট-এফআইইউর প্রধান মাসুদ বিশ্বাস পৃথক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, পণ্যের মূল্য ২০০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি দেখিয়ে (ওভার ইনভয়েসিং) অর্থপাচার করে কতিপয় ব্যবসায়ী গ্রুপ। এটি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিলে আন্ডার ইনভয়েসিং বা পণ্যমূল্য কম দেখিয়ে অর্থ পাচার শুরু করেন এসব ব্যবসায়ী। এ পন্থায় একই সঙ্গে অর্থপাচার ও কর ফাঁকি দেয় চক্রটি। এ ছাড়া গত মে মাসে এবিবি আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বাণিজ্যের আড়ালে প্রতি মাসে দেড় বিলিয়ন ডলার পাচার হচ্ছিল। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী দেশীয় মুদ্রায় এ অঙ্ক ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। পাচারের সঙ্গে জড়িত ছিল বড় শিল্পগ্রুপগুলো। তবে এসব শিল্প গ্রুপের নাম প্রকাশ করেনি এবিবি নেতারা। বাংলাদেশ ব্যাংকও ওভার-আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের সঙ্গে জড়িতদের নাম প্রকাশ করেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বিষয়টি নিয়ে সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন। তবে নির্ধারিত মুখপাত্র ছাড়া গণমাধ্যমে বক্তব্য না দেয়ার বাধ্যবাধকতা থাকায় নাম গোপন রাখতে অনুরোধ করেছেন তিনি। এ কর্মকর্তা বলেন, দেশের বর্তমান আর্থিক সংকটের পেছনে প্রধান কারণ অর্থপাচার। ব্যবসায়ীদের সংযোগ ছাড়া পাচার প্রায় অসম্ভব। ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ পাচারের ঘটনা ঘটছে ব্যবসায়ীক চ্যানেল ব্যবহার করে। তিনি বলেন, ‘ধরুন কোনো রাজনীতিবিদ বা আমলা অর্থপাচার করবে। তখন তারা এটি কিভাবে করবে। ব্যবসায়ীক চ্যানেল ছাড়া অন্য যে রাস্তাগুলো রয়েছে তার সাহায্যে বেশি পরিমাণে অর্থপাচার সম্ভব নয়। আর সেগুলো নিরাপদও নয়। ব্যবাসায়ীরা যদি দেশের কথা চিন্তা করে বাংলাদেশ ব্যাংককে সহযোগিতা করেন তাহলে এ পরিস্থিতি সহজেই উত্তরণ সম্ভব।’
এ কর্মকর্তা বলেন, আমাদের দেশে ক্ষমতাচর্চা রয়েছে। কিন্তু ব্যাংকগুলো কৌশলী ভূমিকা নিলে পাচারকারিদের কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। ব্যাংক যদি পাচারকারিদের তথ্য কৌশলে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানিয়ে দেয় তখন বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবস্থা নিতে পারবে। তবে ব্যবসায়ীদের নিজস্ব ব্যাংক থাকায় এ কাজও সহজ নয় বলে মনে করেন এ শীর্ষ কর্মকর্তা।
গতকাল বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক জানান, দেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এটি নিয়ন্ত্রণের জন্য বেশ কিছু নীতিগত পরিবর্তন নিয়ে আসা হয়েছে কিন্তু এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। আশা করি, আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে পুরোপুরি বাস্তবায়ন হবে এবং একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। দেশের ডলার সংকটের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের অনেকেই রপ্তানি মূল্য দেশে আনছেন না; বরং বিদেশি ক্রেতাদের পণ্যমূল্য পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়ে দিচ্ছেন। ফলে দেশ থেকে আমদানি মূল্য পরিশোধ বাবদ ডলার চলে গেলেও রপ্তানির বিপরীতে তুলনামূলক ডলার কম আসছে। তৈরি হচ্ছে ঘাটতি। এ বিষয়গুলো আমরা নজরে এনেছি এবং তা সমাধানের চেষ্টা করছি।
মুখপাত্র আরও বলেন, বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ৫৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে। কিন্তু দেশে এসেছে ৪৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এখানে ৯ বিলিয়ন ডলারের একটি ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এক প্রশ্নের উত্তরে মুখপাত্র বলেন, অত্যধিক মূল্যে ডলার কেনার জন্য ১০ ব্যাংকের ট্রেজারি কর্মকর্তাকে জরিমানা করা হয়েছে। জরিমানা মওকুফের বিষয়টি বিবেচনা করবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। আইন অনুযায়ী সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হবে। ? ভবিষ্যতে যদি কোনো ব্যাংক আইনের ব্যত্যয় ঘটায় তাহলে তাদেরও জরিমানা করা হবে। হুন্ডি বন্ধের জন্য ইতোমধ্যে আমরা বেশ কিছু পদক্ষেপ হাতে নিয়েছি। ৫০টিরও বেশি অনলাইন সাইট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আমাদের এ সমস্ত কার্যক্রম চলমান।
বৈঠক শেষে এবিবির চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসাইন বলেন, ‘বৈঠকে মূলত দুটি বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে ?। এর মধ্যে একটি হলো সিআইবি। এ নিয়ে আমাদের মধ্যে কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছে। বুদ্ধিমত্তা বৃদ্ধির কিছু কৌশল আমরা হাতে নিয়েছি।