ঢাকার বিভিন্ন বস্তি, গার্মেন্ট কারখানা ও গ্রামাঞ্চলের নারীদের বিনা খরচে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে পাচারে জড়িত কিছু রিক্রুটিং এজেন্সি। স্থানীয় দালাল ও দৈনিক মজুরির কর্মচারীদের লভ্যাংশ দিয়ে একশ্রেণির লোককে এ কাজে লাগাচ্ছে তারা। ওই শ্রেণির লোকই অসহায়, অসচ্ছল ও নিম্ন আয়ের নারীদের বিনা খরচে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় পাঠানোর লোভ দেখিয়ে অফিসে নিয়ে আসে। পরে প্রশিক্ষণের নামে এই নারীদের বিভিন্ন বাসাবাড়িতে আটকে রেখে চলে শারীরিক নির্যাতন। এরপর তাদের ভারতে পাচার করে দেওয়া হয়।
২০১৮ সালের ১ জুন ভুক্তভোগী এক নারী পল্টন থানায় এমন একটি অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা করেন। এতে পাঁচজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় আরও আটজনকে আসামি করা হয়। নাম উল্লেখ করা আসামিরা হলো– ভেলি ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মালিক শেখ ইকবাল, দালাল মো. আলমগীর, শেখ সাদেক, খান ইকবাল ওরফে ইকবাল হোসেন ও আলমগীরের চাচা নূর মোহাম্মদ। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান পল্টন থানার তৎকালীন এসআই সৈয়দ আলী। তিনি তদন্ত শেষে ২০১৯ সালে ১৫ জানুয়ারি দালাল আলমগীরকে অভিযুক্ত করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন। পরে বাদীর নারাজিতে মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য আদালত পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) দায়িত্ব দেন। বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছেন পিবিআইয়ের পুলক সরকার।
মামলার আগের তদন্ত কর্মকর্তা এসআই সৈয়দ আলী বর্তমানে মতিঝিল থানায় কর্মরত। তিনি বলেন, ‘ভুক্তভোগী নারীর ভিসা চলে এলে তিনি সৌদি আরবে কষ্টের কথা শুনে আর যেতে চাননি। পরে সেই ভিসায় অন্য একজনকে পাঠায় রিক্রুটিং এজেন্সি। দালাল আমলগীর ওই নারীকে ফ্লাইটের জন্য বিমানবন্দর নিয়ে যাওয়ার কথা বলে চেতনানাশক পান করিয়ে ভারতে পাচার করে দেয়। ২০২২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোতে (বিএমইটি) বিদেশ পাঠানোর নামে বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগে বিচার চেয়ে আবেদন করেন এক নারী। ওই ভুক্তভোগী নারী অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন, রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর হুজুরপাড়া এলাকায় বস্তিতে ২০১৭ সালের অক্টোবরে একটি ছেলে ও মেয়ে এসে জানায়, তারা বিনা খরচে সৌদিতে বাসাবাড়ির কাজে লোক পাঠাতে পারে। তারা ভেলি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির ভিজিটিং কার্ড দেয় এবং বলে, কেউ যেতে আগ্রহী হলে কার্ডে দেওয়া নম্বরে যোগাযোগ করতে পারেন।
ওই ভুক্তভোগী নারী বলেন, বিনা খরচে সৌদি যাওয়ার কথা শুনে ক’দিন পর তাদের দেওয়া নম্বরে যোগাযোগ করি। সে সময় ভেলি ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মালিক শেখ ইকবাল অফিসে আসতে বলেন। ২০১৭ সালের ২১ অক্টোবর অফিসে আসার পর এক মাসের প্রশিক্ষণ নিতে হবে বলে জানান ইকবাল। প্রশিক্ষণ চলার সময় ইকবাল আমার পাসপোর্ট করে দেন। পাসপোর্ট নিয়ে আসার দিন ইকবালের লোক আলমগীর তার বাসায় নিয়ে আমাকে ধর্ষণ করে। পরদিন বিষয়টি ইকবালকে জানালে তিনি আমাকে ধমক দিয়ে আবার প্রশিক্ষণে পাঠান এবং ভিডিও ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেন। ১৬ এপ্রিল আলমগীর অফিস থেকে আমাকে মালিবাগ নিয়ে গিয়ে একটি বাসে তুলে দেয়। এ সময় বমির ওষুধ, পানি ও জুস কিনে দেয়। সেটা পান করার পর আমি জ্ঞান হারাই। পাঁচ দিন পর ভারতের মুম্বাইয়ের একটি বাসায় আমার জ্ঞান ফেরে। ওই বাসার মালিক সন্তোষ আমাকে মুম্বাইয়ের গ্রিন রোডের একটি যৌনপল্লিতে রেখে আসে।
একটি সূত্র জানায়, ভুক্তভোগী নারীকে সৌদি আরব পাঠানোর জন্য সবকিছু করে ভেলি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল। ওই নারীর বিএমইটি কাগজপত্র করে আল-বুরুজ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি। ২০২২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়ার দেড় বছরেও বিষয়টির কোনো সমাধান করতে পারেনি বিএমইটি। ওই সময়ের মধ্যে বেশ কয়েকবার দুই পক্ষকে অফিসে আসার নোটিশ দেওয়া হয়। উভয় এজেন্সির কোনো প্রতিনিধি হাজির হয়নি। পরে বিএমইটি এ বিষয়ে কাজ করতে অপারগতা প্রকাশের পর বর্তমানে অভিযোগ নিয়ে কাজ করছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এনফোর্সমেন্ট শাখার উপসচিব মঈনুল হাসান।
উপসচিব মঈনুল হাসান বলেন, ভেলি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ও আল-বুরুজ ইন্টারন্যাশনালের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। কোনো রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আগামী সপ্তাহে উভয় এজেন্সির লোকজনকে ডাকা হবে। তারা এলে বিষয়টি নিয়ে তাদের সঙ্গেও কথা হবে। একই সঙ্গে মানবসম্পদ রপ্তানির নামে কীভাবে ওই নারী ভারতে পাচার হলো তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে সে বিষয়ে।