সরকার পতনের একদফা আন্দোলন শুধু ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ রাখতে চায় না বিএনপি। দলটি মনে করছে, ঢাকাকেন্দ্রিক আন্দোলন হলে সেটি নিয়ন্ত্রণে ক্ষমতাসীনরা সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগের সুযোগ পাবে। এ কারণে আন্দোলনের পরিধি তারা তৃণমূল পর্যন্ত নিতে চায়। এ ছাড়া শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে সরকারের পক্ষ থেকে বাধা এলে সড়ক ও নৌপথ অবরোধের চিন্তাও আছে বিএনপির।
সরকারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বিএনপি আশঙ্কা করছে, আগামী দিনে তাদের জ্যেষ্ঠ অনেক নেতা গ্রেপ্তার হতে পারেন। সে ক্ষেত্রে আন্দোলন কীভাবে এগোবে, তা-ও ভেবে রেখেছে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা জানি, এ ধরনের সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে বিগত দিনের মতো নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করতে পারে, সাজাও দিতে পারে। শক্তি প্রয়োগ করে বাঁচার চেষ্টাই তাদের একমাত্র পথ। এটা করেও সরকারের শেষ রক্ষা হবে না।’
বিএনপির একাধিক সূত্র জানায়, হঠাৎ করে মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচি করতে সারাদেশের নেতাকর্মীদের ঢাকায় আসার আহ্বান জানানো হয়। তখনো তৃণমূল বিএনপি নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ওই সময় নেতাকর্মীরা ঢাকায় এসে অবস্থান নেয়। কিন্তু সেবার ঢাকার নেতারা মাঠে না থাকায় ওই কর্মসূচি ব্যর্থ হয়। এরপর তৃণমূলের নিয়ন্ত্রণ হারায় বিএনপি। এবার সেই পথে হাঁটতে চায় না দলটি। এ কারণে ঢাকার পাশাপাশি জেলা, মহানগর ও উপজেলা পর্যায়ে কর্মসূচি রাখবে তারা।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতা বলেন, ‘২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ থেকে গণতান্ত্রিক কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। কিন্তু সেই কর্মসূচিতে সরকার বাধা দিলে বিএনপি ছেড়ে কথা বলবে না।’
বিএনপির একাধিক সূত্র জানায়, শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা এলে আন্দোলন তীব্র হবে। সে ক্ষেত্রে সড়ক ও নৌপথ অবরোধের মতো কর্মসূচিও আসতে পারে।
দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, ঢাকা বা ঢাকার বাইরে কী ধরনের কর্মসূচি হতে পারে, বা কোন ধরনের কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলন শুরু হবে, তা নিয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি দলটি। তবে বিশেষ কিছু কর্মসূচি মাথায় রেখে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা ধারাবাহিক বৈঠক করছেন। আন্দোলনে কোন নেতার কী ভূমিকা থাকবে, সে ব্যাপারেও চিন্তাভাবনা চলছে।
গতকাল সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বিএনপিকে উদ্দেশ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘১০ ডিসেম্বর তারা গোলাপবাগ গরুর হাটের খাদে পড়েছিল, এবার কোথায় যাবে, সেটা দেখার অপেক্ষায় আছি।’
এ প্রসঙ্গে বিএনপির এক জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যে মনে হয়েছে, আগামী ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশের স্থান নিয়ে সরকার ঝামেলা করতে পারে। দলের মহাসচিবসহ জ্যেষ্ঠ নেতাদের গ্রেপ্তারও করা হতে পারে। সব ধরনের শঙ্কা মাথায় রেখেই চূড়ান্ত আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। নেওয়া আছে বিকল্প প্রস্তুতিও।
গত ১৮ অক্টোবর রাজধানীতে জনসমাবেশ করে বিএনপি। পরের কর্মসূচি আগামী ২৮ অক্টোবর। কর্মসূচিতে ১০ দিনের বিরতি রাখার প্রসঙ্গে বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতা আমাদের সময়কে বলেন, ‘বেশ কিছু কারণ রয়েছে। যেমনÑ নিরপেক্ষ সরকার ইস্যুতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও গণতান্ত্রিক বিশ^সহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে শেষবারের মতো একটা বার্তা দেওয়া। সরকারকে বার্তা দেওয়া হয়েছেÑ চাইলে তারা এ সময়ের মধ্যে প্রকাশ্যে অথবা পর্দার আড়ালে নিরপেক্ষ সরকার ইস্যুতে আলোচনা করতে পারে। আবার আন্তর্জাতিক বিশ্বকে বোঝানোর চেষ্টা চলছে যে, আমরা সব চেষ্টা করেছি; বাধ্য হয়ে চূড়ান্ত আন্দোলনের পথে হাঁটতে বাধ্য হয়েছি। এখানে আমাদের কিছু করার ছিল না।’
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে প্রমাণ হয়ে গেছে, শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে অবাধ নির্বাচন সম্ভব নয়। এ অবস্থায় আমাদের লক্ষ্য হলো, ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। আমরা তো সরকারকে সব ধরনের সুযোগ দিয়েছি। চাইলে এখনো সময় আছে, নিরপেক্ষ সরকার ইস্যুতে আলোচনা করার।’
দলীয় সূত্রে জানা যায়, আগামী ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশের মধ্য দিয়ে একদফা দাবিতে শেষ ধাপের আন্দোলনে নামতে যাচ্ছে বিএনপি। বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, ওই মহাসমাবেশের মধ্য দিয়ে আন্দোলনের মহাযাত্রা শুরু হবে, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত যা চলমান থাকবে। সমমনা দলের বাইরে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলোচনার পর জামায়াতসহ ইসলামপন্থি বেশ কয়েকটি দলও চলমান আন্দোলনে অংশ নিতে সম্মত হয়েছে। তবে চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলাম চলমান বিএনপির আন্দোলনে থাকবে কিনা, তা এখনো নিশ্চিত নয়।
বিএনপি বলছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘিরে আবির্ভূত হবে মহাযাত্রার কর্মসূচি, যার মূল লক্ষ্য থাকবে তফসিল ঘোষণা ঠেকানো।
এ দিকে বিএনপির চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলনের সঙ্গে কঠোর কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকবে ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্রঐক্য। তাদের মূল লক্ষ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক আন্দোলন গড়ে তোলা। এর অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় ছাত্র সমাবেশ করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের, যদিও দিনক্ষণ এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
তবে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, সরকারের যদি বোধোদয় না হয়, ২৮ অক্টোবরের পরের দিন থেকে লাখ লাখ মানুষ রাজপথে নেমে আসবে। স্বীকৃত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের যে ফর্মগুলো রয়েছে যেখানে অবস্থান, বিক্ষোভ, ঘেরাও, অবরোধ এমনকি হরতাল পর্যন্ত আছে পর্যায়ক্রমে সেগুলো আমরা অ্যাপ্লাই করব। তবে আমরা কখন কোনটাতে যাব সেটা নির্ভর করবে সরকার ও প্রশাসনের আচরণের ওপর। আমাদের লক্ষ্য, শেষ পর্যন্ত পুরো আন্দোলনকে শান্তিপূর্ণ রাখা। আমরা সরকারের উসকানি, সহিংসতা এড়িয়ে কর্মসূচি করতে চায়Ñ যেন লাখ লাখ মানুষ এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। তিনি আরও বলেন, সরকার যদি দমন-পীড়ন চালিয়ে আন্দোলনকে নিঃশেষ করতে চায়, তাহলে সে চিন্তা হবে খুবই হঠকারী এবং তা সরকার ও সরকারি দলের জন্য বুমেরাং হতে বাধ্য। সে ক্ষেত্রে সহিংসতার পুরো দায়-দায়িত্ব তাদেরকেই বহন করতে হবে