ভোগ্যপণ্যের আগুন-দামে পুড়ে যাচ্ছে স্বল্পআয়ের মানুষের পকেট। এমনিতেই উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে নাভিশ্বাস দশা; জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ। এর ওপর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি জীবনযাপনকে আরও কঠিন চাপের মধ্যে ফেলেছে।
মূল্যস্ফীতির চাপ লাগাতার বাড়লেও মানুষের আয় সেভাবে বাড়ছে না। বর্ধিত আয়ের পুরোটাই চলে যাচ্ছে মূল্যস্ফীতির পেটে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। ফলে তারা ব্যয় কমাতে বাধ্য হচ্ছেন, এমনকি অবশ্য-প্রয়োজনীয় অনেক ব্যয়েও কাটছাঁট করতে হচ্ছে। এর পরও সামাল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। দীর্ঘদিন তিল তিল করে জমানো সঞ্চয় ছিল যাদের, তারা সে সঞ্চয় ভাঙতে বাধ্য হচ্ছেন। যাদের তা-ও নেই, তারা চলছেন ধারকর্জ করে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, গত আগস্ট মাসের চেয়ে সামান্য কমে সেপ্টেম্বরে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশে। আগস্টে এটি ছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। তবে সেপ্টেম্বরে গ্রাম-শহর নির্বিশেষে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখনো ১২ শতাংশের ওপরে রয়ে গেছে। গত আগস্ট মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হঠাৎ করে অনেক বেড়ে যায়। সেই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ যা ছিল ১১ বছর ৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৭৩ শতাংশে উঠেছিল। সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বর মাসে গ্রাম-শহর মিলিয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে সীমিত ও নিম্ন আয়ের মানুষ কতটা চাপে রয়েছে। ক্রমাগতভাবে এ চাপ অব্যাহত থাকায় মধ্যবিত্তরাও এতে নতুন করে যুক্ত হয়েছে।
মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও বেশ উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার খুব বেশি উদ্যোগ নেয়নি। গত বছর অনেক কথা বলা হয়েছে সে রকম উদ্যোগ ছিল না। ইদানীং কিছু নেওয়া হচ্ছে। গত বছর ডলারের রেট বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, সেটা ভুল পদক্ষেপ ছিল। এতে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট দেখা দিয়েছে। আমদানি কমে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। এটা মূল্যস্ফীতিকে উল্টো উসকে দিচ্ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সঠিক মডেল নেওয়া হয়নি। তাই হিতে বিপরীত হচ্ছে।
এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, বাজারে অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে। প্রতিযোগিতামূলক বাজারের অভাব রয়েছে। ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে অতি মুনাফা করছে। সমস্যার গোড়ায় হাত না দিয়ে সরকার কিছু পণ্যের দাম বেঁধে দিচ্ছে। কিন্তু তা তো কার্যকর হচ্ছে না। উল্টো সে পণ্যের বাজার ‘মারা’ যেতে পারে। কারসাজি ঠেকাতে দাম বেঁধে দিলে তো হবে না।
কারসাজিকারীদের পাকড়াও করতে হবে। তা না করে রোগের উপসর্গগুলো না বুঝে ‘প্যারাসিটামল চিকিৎসা’ দেওয়া হচ্ছে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে, বছরের ব্যবধানে প্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের দাম উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। সংস্থাটির হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চালের দাম অনেকটা উচ্চমূল্যেই স্থিতিশীল রয়েছে। ভোজ্যতেলের দাম কমলেও সহনীয় পর্যায়ের নয়। অপরদিকে একই সময়ের ব্যবধানে বড় দানার মসুর ডালে ১০.২৬ শতাংশ, চিনিতে ৪২.১১ শতাংশ ও দেশি পেঁয়াজে ৮০.৯৫ শতাংশ দাম বেড়েছে। দেশি ও আমদানিকৃত রসুনের দাম যথাক্রমে ৬০.৬৫ ও ৮৫ শতাংশ বেড়েছে। আমদানিকৃত আদায় বেড়েছে ৮০ শতাংশ। জিরার দাম বেড়েছে ১২৭.২৭ শতাংশ। বেড়েছে গরম মসলার দামও। এক বছরে ব্রয়লার মুরগিতে খরচ বেড়েছে প্রায় ৯ শতাংশ। ফার্মের ডিমের হালিতে বেড়েছে ৮.২৫ শতাংশ। কাঁচা বাজারে আলুতে ৮৮.৪৬, কাঁচামরিচে ১৪০ এবং লম্বা বেগুনে ২৩ শতাংশ দাম বেড়েছে। দাম বাড়ার দৌড়ে লবণও বাদ পড়েনি, এক বছরে বেড়েছে ৯.৫৯ শতাংশ।
এক হাজার টাকা নিয়ে বাজারে আসা ক্রেতাদের পকেট ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে কয়েকটি পণ্য কিনতেই, প্রয়োজনীয় অনেক পণ্য কেনা বাকি থাকতেই। এক হাজার নোট নিয়ে বাজারে গিয়ে এই প্রতিবেদক কেবল চাল, ডাল, তেল, ডিম, পেঁয়াজ ও লবণ কিনতে পেরেছেন। এর মধ্যে ২ কেজি মাঝারি চাল কিনতে ১১০ টাকা, ১ কেজি মসুর ডাল (বড় দানা) ১১০ টাকা এবং ১ লিটার সয়াবিন তেল ১৬৫ টাকা খরচ হয়েছে। সবজির বাজারে আধা কেজি করলা ৫০ টাকা, ১ কেজি চিচিঙ্গা ৭৫ টাকা, এক পিস লাউ ৮০ টাকা এবং ২৫০ গ্রাম কাঁচা মরিচ ৫০ টাকাসহ মোট ৩২০ টাকা খরচ হয়েছে। এছাড়া ১ ডজন ফার্মের ডিম ১৬০ টাকা, ১ কেজি লবণ ৪০ টাকা এবং ১ কেজি দেশি পেঁয়াজ ১০০ টাকা দিয়ে কিনতেই ফুরিয়ে যায় পকেটের ১ হাজার টাকার নোটটি। অথচ, রান্নার জন্য এখনও দরকার আদা, রসুন, হলুদ, মরিচের গুড়া, অন্যান্য মসলা। সাধের মাছ কিংবা মাংস তো দুরে থাক এক কেজি চিনিও কেনা সম্ভব হয়নি।
রাজধানীর কদমতলী বাজারেই কথা হয় বেসরকারি চাকরিজীবী মো. সাইফুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, আগে একশ থেকে দেড়শ টাকার মধ্যে শাক-সবজি, কাঁচামরিচ, ধনে পাতা কেনা গেছে। এখন এগুলো কিনতেই ৩শ-৪শ টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। মসলাপাতির দামেও আগুন। মাছ, মাংস কেনা কঠিন হয়ে পড়েছে। সস্তার পাঙ্গাশ এখন আর সস্তা নেই। এটিও এখন ২শ ছাড়িয়েছে। ব্রয়লারের কেজিও ২শ টাকা। সব মিলিয়ে সীমিত আয়ে বাজার ব্যয়ের সঙ্গে কুলোতে পারছি না। তিনি বলেন, এখন টিকে থাকাই অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে।
সরকার পেঁয়াজ, আলু ও ডিমের দাম বেঁধে দিলেও তা কার্যকর হয়নি বরং দাম আরও বেড়েছে। এখন ডজন ১৬০ টাকা। নতুন করে দেশি পেঁয়াজের দাম গতকাল সেঞ্চুরি করেছে। আলুর দামও বেড়ে ৪৮ থেকে ৫০ টাকা হয়েছে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বাজারে মূল্যস্ফীতির চাপ রয়েছে। কিন্তু এর পাশাপাশি একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী কৃত্রিমভাবে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে। দাম বেঁধে দিলেই হবে না, তা কার্যকরও করতে হবে। যদিও মুক্তবাজার অর্থনীতিতে দাম বেঁধে দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ কঠিন।
তিনি আরও বলেন, বাজার তদারকি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে। তা ছাড়া জনবলও কম। বাজার নিয়ন্ত্রণে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে তা ‘আগুন নেভানোর মতো’। আগুন লাগলে পানি ঢালছি। আগুন লাগার কারণগুলো দূর করছি না। এতে কাক্সিক্ষত ফল মিলছে না।
তিনি বলেন, প্রতিযোগিতামূলক বাজার নিশ্চিত করতে হবে আমাদের। চাহিদা ও সরবরাহের পরিসংখ্যানে নজর রাখতে হবে। সরবরাহ স্বাভাবিক কিংবা তার কাছাকাছি রাখলে দাম অতিরিক্ত বাড়তে পাড়বে না। প্রয়োজনে আমদানিও করা যেতে পারে। তবে আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত দেশীয় উৎপাদন বাড়ানো।
গতকাল সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বাজারে ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়ে ২শ টাকায় দাঁড়ায়। মাছের বাজারে যাওয়াই দায়! সব ধরনের মাছের দাম নিম্নবিত্তের নাগালের বাইরে। বর্তমানে বাজারে সবার মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সবজির দর। মাছ, মাংস ও ডিমের চড়া বাজারে শেষ ভরসা যে সবজি, তার দামও আকশচুম্বী হয়ে গেছে। বর্তমানে এক কেজি সবজির দামে দেড় থেকে দুই কেজি চাল কেনা যাবে। পেঁপে আর কাঁচাকলা ছাড়া কোনো সবজিই ৮০ টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না। শতকের ঘর ছুঁয়েছে করলা, উচ্ছে, বেগুন, শিম, বরবটি ও গাজর। পটোল ও চিচিঙ্গার কেজি ৮০ টাকা, ধুন্দুল ৮৫ টাকায় ঠেকেছে। ঢেঁড়স ও মুলাও ৭০-৮০ টাকা। লাউ ৮০ টাকাতেও বিক্রি হচ্ছে। কাঁচামরিচের কেজি ২০০ থেকে ২৪০ টাকা।
সবজির দাম শুনে কান গরম হয়ে গেছে, বলছিলেন মালিবাগ বাজারে বাজার করতে আসা লাভলী আক্তার। তিনি ক্ষেদের সঙ্গে বলেন, দুই বেলার রান্নার জন্য আধা কেজি করে দুই পদের সবজি কিনতে এসে দেখছি দামের আগুন লেগেছে। ১শ টাকা নিয়ে এসেছিলাম। কেনা সম্ভব হচ্ছে না। পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে তাতে সবজির বাজারেও এখন ৫০০ টাকার নোট নিয়ে আসতে হবে।
খোদ সবজি ব্যবসায়ীরাই বলছেন, এমন দাম আগে কখনই দেখেননি তারা। মালিবাগ বাজারের সবজি বিক্রেতা মো. মোকাদ্দেস বলেন, বছরের এমন সময় সবজির দাম সাধারণত একটু বেশি থাকে। কিন্তু এবার অত্যধিক বেশি।
পাইকারি বাজার কারওয়ানবাজারে সবজি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স রিয়াদ এন্টারপ্রাইজের ব্যবসায়ী বলরাম চন্দ্র বলেন, বৃষ্টির কারণে ক্ষেতে কিছু সবজি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় রাজধানীতে সবজির সরবরাহ কম এখন। তাই দাম বাড়তি।
তবে বাজার বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সবজির ক্ষেত্রে মাঠ থেকে ভোক্তা পর্যায় পর্যন্ত অনেক হাত বদলায়। এতে করে ভোক্তারা বেশি দামে কিনছেন অথচ কৃষকরা পাচ্ছেন কম দাম।