মাঠে খেলে দুই দল। তৃতীয় পক্ষ খেলে মাঠের বাইরে। সারা বছর অনলাইন জুয়া বা বেটিং রমরমা থাকলেও বিশ্বকাপ ক্রিকেটের বড় আসর ঘিরে বেটিং চলছে রমরমা। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় অনলাইন বেটিংয়ের বিজ্ঞাপন চলছে। শুধু শহরে নয়, প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে গেছে অনলাইন বেটিং। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বিনোদনের চেয়ে এখন জুয়া খেলায় মত্ত থাকেন বাজিকররা। বাজিতে কোটি কোটি টাকা উড়ে বাংলাদেশে। রাজধানীর পুরান ঢাকা থেকে শুরু করে উত্তরের উত্তরা পর্যন্ত অনলাইনে বাজিতে কোটি টাকা লগ্নি হচ্ছে। একেকটি ম্যাচকে ঘিরে প্রতিদিন কোটি টাকার বাণিজ্যের নামে মাফিয়াদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে শত শত মানুষ নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, অনেক দেশে জুয়া খেলা বৈধ হলেও বাংলাদেশে অবৈধ। এ ধরনের জুয়ায় শত শত কোটি টাকা ক্রিপ্টোকারেন্সি বা বিটকয়েন হয়ে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। জুয়াড়িদের ধরতে বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালানো হয়েছে। সাইবার মনিটরিংয়ের মাধ্যমে অনেককে আইনের আওতায়ও আনা হয়েছে। কিন্তু ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্কের (ভিপিএন) মাধ্যমে দেশের বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় জুয়ার সাইট বন্ধ করতে সময় লাগে।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, অনলাইন বেটিং বা জুয়ার বিরুদ্ধে র্যাবের অভিযান চলছে। কিন্তু দেশের বাইরে থেকে এসব সাইট পরিচালনা করা হয়। বেটিংয়ে টাকা অনলাইনে পেমেন্ট করার পর সেই টাকা চলে যায় সাইট পরিচালনাকারীদের কাছে। সেই টাকা ক্রিপ্টোকারেন্সি হয়ে চলে যায় মূল পরিচালনকারীদের কাছে। ক্রিপ্টোকারেন্সি সেই দেশের কারেন্সিতে পরিণত করা হয়। কারণ ক্রিপ্টোকারেন্সি ঐ সব দেশে বৈধ।
বর্তমানে ফেসবুক, ইউটিউব এবং অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফরমে দেখা যায়, অসংখ্য চোখ ধাঁধানো বিজ্ঞাপন। শর্টকাট উপায়ে লোকদের প্রলুব্ধ করে কোটিপতি হতে। এই বিজ্ঞাপনগুলো পুরস্কার হিসেবে বিপুল পরিমাণ অর্থ, বাড়ি, গাড়ি এবং দামি স্মার্টফোনসহ বিভিন্ন বিলাসবহুল আইটেম প্রদর্শন করে এবং সেগুলো জিতে নিতে অনলাইন ট্রেডিং বা জুয়া খেলতে উত্সাহ দেয়।
ফেসবুক ও অন্যান্য প্ল্যাটফরমে শত শত পেজ আছে যেগুলো জুয়া খেলার জন্য পরিচিত। যেমন—সোলার ভ্যালি, ক্যাশ রিভার স্টস, ক্লাব৯৯৯ অনলাইন গ্যাম্বলিং এবং ভেলকি। এসব পেজের বেশির ভাগই বিদেশ থেকে পরিচালিত হচ্ছে। অন্যদিকে বেট৩৬৫.কম, বিডিটি১০.কম, বেটস্কোর২৪.কমসহ ৫০টির বেশি ওয়েবসাইটে ডিজিটাল প্ল্যাটফরমের মাধ্যমে চলছে অনলাইন জুয়া বা বেটিং।
অনলাইন বেটিং সাইটগুলোর অনেকগুলোতে এমনিতেই যে কেউ ঢুকতে পারেন। আবার কোনো বেটিং সাইটগুলোতে নিবন্ধন করে ঢুকতে হয়। নিবন্ধন করতে আবার দ্বিগুণ টাকা দিতে হয়। আবার কোনো কোনো সাইটগুলোতে ক্রিপ্টোকারেন্সি অথবা ডলার দিয়ে প্রবেশ করতে হয়। আবার যে দেশগুলোর সাইট নিজস্ব তাদের টাকা দিয়ে কয়েন ক্রয় করে সাইটগুলোতে প্রবেশ করতে হয়। আর এর লেনদেন হচ্ছে বিকাশ, নগদ, রকেট অথবা ভিসা, মাস্টারকার্ডে। তবে এই মাধ্যমে লেনদেনে জড়িত থাকে স্থানীয় এজেন্টরা। কোনো বেটিং সাইটে বিট কয়েনের মাধ্যমে কেউ কেউ অংশ নিচ্ছে। জুয়ার পর ঐ সব অর্থ ক্রেডিট কার্ড, ই-ব্যাংকিংয়ের ও হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার হচ্ছে। জুয়া বাবদ দিনে কী পরিমাণ টাকা মানি লন্ডারিং হচ্ছে তার কোনো হিসাব নেই সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে।
সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজাদ রহমান বলেন, বিভিন্ন সময়ে সিআইডি অভিযান চালিয়ে অনলাইন বেটিং বা জুয়াড়িদের গ্রেফতার করা হয়। এদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে বাংলাদেশে সাইট পরিচালনাকারীদের মধ্যে বেশ কয়েক জনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা প্রক্রিয়াধীন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকার গত কয়েক বছরে ৩ হাজার ৫০০টিরও বেশি জুয়ার সাইট বন্ধ করেছে। সিআইডি, ডিবি ও র্যাবের হাতে ধরা পড়েছে জুয়ার সাইট পরিচালনাকারী শতাধিক ব্যক্তি। তবে প্রতিটি সাইট বন্ধ করার পরপর এই চক্র ভিপিএন (ভয়েস ওভার প্রটোকল নেটওয়ার্ক) দিয়ে সাইটগুলো আবার সচল করে।
রাজধানীর পুরান ঢাকার বংশাল, ইসলামপুর, লালবাগ, চকবাজার, লক্ষ্মীবাজার, গেন্ডারিয়া, নারিন্দাসহ বেশির ভাগ এলাকার নিম্নশ্রেণির পেশাজীবীর মধ্যে আইসিসি ওয়ার্ল্ডকাপকে কেন্দ্র করে বেশির ভাগ সময় অনলাইনে বুঁদ হয়ে থাকে। সদরঘাটের ফুটপাতের একজন চা-দোকানি অনলাইনে জুয়া খেলেন। গত সপ্তাহে একটি খেলার বাজি ধরার অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ঐ দিন এক খেলায় দেখলেন বিরাট কোহলি ওভারে অন্তত একটি ছক্কা মারতে পারেন। বাজি ধরলাম ১ হাজার টাকা। কিন্তু ওভারের কোনো বলেই ছক্কা না হওয়ার কারণে বাজিতে হেরে গেলাম। যদি ছক্কা মারতেন, তাহলে আমি ১০ হাজার টাকা পেতাম। কিন্তু হলো না।
ফুটপাতের চা-দোকানি থেকে শুরু করে সেলুন দোকানদার, হকার, বাড়ির নিরাপত্তা প্রহরী, বিক্রয় কর্মী থেকে শুরু করে ভবঘুরে, বাস-ট্রাকের চালক-হেলপার, সিএনজি চালক, নির্মাণ শ্রমিক, গৃহপরিচারিকা, রিকশাচালক ও দিনমজুর শ্রেণির মতো একেবারে নিম্ন আয়ের মানুষ এখন দিনের একটা সময় অনলাইনে বাজি ধরতেই ব্যস্ত থাকে। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ম্যাচ চলাকালীন সবচেয়ে বেশি জুয়া চলে। ১ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত এই শ্রেণির মানুষ বাজি ধরে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তো রয়েছেই, স্কুলের নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরাও অনলাইনে বাজি ধরতে বেশ পটু।
এ ব্যাপারে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত বিপুলসংখ্যক অনলাইন জুয়ার সাইট বন্ধ করেছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে আমাদের কাছে প্রায়ই তালিকা আসে। সেগুলোও বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু জড়িতদের একটা সাইট বন্ধ করে দিলে, তারা একাধিক সাইট খুলে ফেলে। এই অনলাইন জুয়ার বিষয়টি আমাদের নজরে আছে। সামনে যে সব সাইটের খবর জানতে পারব, সে সব সাইটও বন্ধ করে দিব। অনেক সময় ফেসবুকেও জুয়া খেলা হয়। আমরা এসব অভিযোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুক ঐসব সাইট বন্ধ করে দেয়।