বিএনপিতে আত্মগোপন রহস্য!

বিএনপিতে আত্মগোপন রহস্য!

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিরোধী রাজনীতির অন্যতম বড় নেতা। তিনি এখন কারাগারে। বিএনপির অন্যান্য শীর্ষ নেতার বাসায় বাসায় চলছে পুলিশি অভিযান। আতঙ্কে সবাই এখন আত্মগোপনে। এতে ভয় পাচ্ছেন পরিবারের সদস্যরা। দলটির নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বলছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই সরকার বিরোধী দলকে হামলা করে, মামলা দিয়ে, ভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি করে দমন করতে চাচ্ছে। গত শনিবারের মহাসমাবেশ থেকে অবরোধের মতো কর্মসূচির ভাবনা ছিল বিএনপির। প্রস্তুতি ছাড়াই সেদিন পরিস্থিতি সহিংসতার পথে চলে গিয়েছিল। তাই দেশব্যাপী হরতাল, এরপর টানা ৭২ ঘণ্টা অবরোধের মতো বড় কর্মসূচির পথে হাঁটতে হয়েছে।

গতকাল দলটির তিন নেতা অবরোধে নিহত হয়েছেন। এটিকে তারা স্বাভাবিকভাবে দেখলেও দলটির হাইকমান্ডে আরও মহাতঙ্ক কাজ করছে। তারা মনে করছেন, কূটনৈতিক মিশনসহ দলের আন্দোলনে সরকার এবার চলে যেতে বাধ্য হবে। তফসিল ঘোষণা হলেও চলবে তাদের সিরিজ কর্মসূচি। এর মধ্যে আসছে জানুয়ারিতে দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটি ভিন্ন দৃশ্যপট তৈরি হবে। কিন্তু সরকার যদি শেষবেলায় এসে ক্ষমতা ছাড়ার মতো পরিস্থিতিতে পড়ে যায়, তাহলে বিরোধী রাজনীতিতে গুপ্তহত্যার মতো এক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এখন থেকেই ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের একটি দ্বিতীয় অধ্যায়ের আশঙ্কা বিরাজ করছে বিরোধী রাজনীতিতে। এমন একটি আশঙ্কা থেকে বিএনপির হাইকমান্ড এখন থেকেই সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েই আন্দোলন সামনের দিকে নিয়ে যাবে তারা। নির্বাচনপূর্ব পর্যন্ত সরকারের চাপ কী হবে— সেটি ধরে নিয়েই ধাপে ধাপে পা বাড়িয়ে টিকে থাকার লড়াই করবে।

বিএনপির কূটনৈতিক মিশনের সূত্রগুলো বলছে, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো এবার দেশে নির্বাচন হচ্ছে না। এবার কূটনৈতিক বড় ধরনের হস্তক্ষেপ থাকবে। তারা বলছেন, সম্প্রতি ঢাকার সহিংসতায় তদন্ত ও জবাবদিহি চেয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রয়োজনে যে কোনো পদক্ষেপ নেবে বলেও জানিয়েছে তারা। এছাড়া ঢাকায় গত ২৮ অক্টোবরের রাজনৈতিক সমাবেশকে কেন্দ্র করে সহিংস ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ সাত দেশ। তারা সহিংসতা বন্ধ করে অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করতে সব পক্ষকে একসঙ্গে কাজ করতে আহ্বান জানিয়েছে।

এদিকে গতকাল ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সাংবাদিকদের বলেছেন, গণতান্ত্রিক নির্বাচনে কোনো পক্ষের সংঘাতের জায়গা নেই। উদ্বেগ প্রশমন এবং একটি অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পথ খুঁজতে সব পক্ষ শর্তহীন সংলাপে বসা প্রয়োজন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রটি বলছে, আগামী দু-একদিনে কূটনৈতিক আরও বেশকিছু আবহাওয়া তৈরি হবে। দেশে যেভাবে সংঘাত তৈরি হয়েছে, এটি গণতান্ত্রিক দেশগুলোর কেউ কামনা করছে না। তারা দাবি করছে, ঢাকায় হামলা-সহিংসতায় বড় কোনো অ্যাকশনে যাচ্ছে না র?্যাব। কারণ, এই বাহিনীতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তারা যদি এখন কোনো ভায়োলেন্সে জড়ায়, তাহলে আন্তর্জাতিক কোর্টে মামলার আশঙ্কায় পড়বে। যেমন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আন্তর্জাতিক কোর্টের মামলায় পড়ে তিনি এখন তার সুরক্ষিত সীমানার বাইরে যাচ্ছেন না। তাই র?্যাবও সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতিগুলোতে তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে; বড় কোনো ঝুঁকিতে পা দিচ্ছে না। বিরোধী শিবিরের বড় একটি অংশ র?্যাবের মতো দেশের আরও কিছু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ে কাজ করছে। তারা গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও সংশ্লিষ্ট অভিযোগগুলো বিশ্বদরবারে উপস্থাপন করছে। তারা চাচ্ছে, সরকারের শক্তিকে যে কোনোভাবে ছোট করে নিয়ে আসতে। তাই র‌্যাবের মতো আরও কিছু বাহিনীর ওপর চাপ তৈরিতে বা র‌্যাব ভাগ্যের জন্য পর্দার আড়ালে চালাচ্ছে রাজনৈতিক পদক্ষেপ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা জানিয়েছেন, দেশের পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তা শুধু বিএনপির জন্যই নয়— আওয়ামী লীগের জন্যও ভালো নয়। বিএনপি এই সরকারের অধীনে এবার নির্বাচনে যাবে না। সরকারকে দাবি মানতে যা কিছু প্রয়োজন, তা-ই করবে। অবরোধ শেষে আগামী শুক্র ও শনিবার বিএনপি ছোট কর্মসূচি রাখবে। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসতে চেষ্টা করবে। রোববার থেকে তাদের আবার বড় কর্মসূচি থাকবে। এর মধ্যেও বিএনপির বড় নেতা যারা রয়েছেন, তারা গুপ্তহত্যার আশঙ্কায় খুব সহজেই প্রকাশ্য কর্মসূচিতে আসবেন না। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কঠোর বার্তা দিয়েছেন, এবার তারা আর এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবেন না। সরকার যদি সবকিছু উপেক্ষা করে নির্বাচন করেও ফেলে, তবুও তাদের আন্দোলন চলতে থাকবে। সরকারের পতন পর্যন্ত তাদের আন্দোলন চলবে। তফসিল ঘোষণা ও সময়সীমা পর্যন্ত পরিস্থিতিগুলো খুবই সতর্কতার সঙ্গে মোকাবিলা করবে তারা।

নির্বাচনি আশঙ্কা থেকে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, সরকার বেধড়ক ধরপাকড় করে বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণের সব রাস্তাই বন্ধ করে দিচ্ছে এবং দেবেও। ২৯ অক্টোবরের হরতালের প্রতি দেশের বড়-ছোট প্রায় সব রাজনৈতিক দলের সমর্থনে এটাও স্পষ্ট যে, তারা এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না।

গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেছেন, দেশ গভীর সংকটের দিকে যাচ্ছে। এ মুহূর্তে একটি বড় রকমের বিপর্যয় হোক, আমরা কেউ তা চাই না। ২৮ অক্টোবর তো শেষ নয়। বলা যায় শেষের শুরু। আগামী জানুয়ারির পয়লা সপ্তাহে সংসদ নির্বাচন হবে বলে কথাবার্তা হচ্ছে। এখন যেভাবে মাঠ গরম হচ্ছে, তা দিন দিন আরও তেতে উঠবে।

রাজনীতি শীর্ষ সংবাদ