ঢাকায় গত ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের পর এক দিন হরতাল ও টানা তিন দিন সড়ক, রেল ও নৌপথ অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে দ্বিতীয় দিন অবরোধ পালন করে বিএনপি ও জামায়াত। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে রাজপথে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। বিরোধী দলগুলোকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার ঘোষণা দিয়ে দলটির নেতাকর্মীরা সরব অবস্থানে রয়েছে। দুই বিরোধীয় পক্ষের মুখোমুখি অবস্থানের কারণে দেশের স্বাভাবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে চলমান অচলাবস্থা নিরসনে এখনো সংলাপের আশা ছেড়ে দেননি নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বিদেশিরাও সংলাপের পক্ষে, সরকারপ্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৩১ অক্টোবর সংলাপের সব সম্ভাবনা নাকচ করে দেয়ার পর দিন গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আবার আশার কথা শুনিয়েছেন। ৩১ অক্টোবর প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক করে বের হয়ে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত শর্তহীন সংলাপের তাগিদ দিয়েছেন। গতকাল ঢাকা নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূতও সংলাপের তাগিদ দিয়েছেন। ফলে রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সংলাপের সম্ভাবনা এখনো শেষ হয়ে যায়নি।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা এ মাসেই হচ্ছে, এমনটিই জোর দিয়ে বলছে নির্বাচন কমিশন। জাতীয় নির্বাচনে অনুষ্ঠানে সব ধরনের প্রস্তুতিও নেয়া হয়ে গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে কমিশনকে সব ধরনের সহযোগিতাও দেয়া হচ্ছে। কিন্তু বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীসহ দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এই কমিশন ও সরকারের অধীনে ভোট কোনোভাবেই মানছে না। তারা নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের অধীনে ভোট অনুষ্ঠানের আন্দোলনে রয়েছে। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার দাবিতে গত ২৮ অক্টোবর বিরোধী দলগুলো ঢাকায় বড় ধরনের শোডাউন দেয়, মহাসমাবেশ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। আওয়ামী লীগও অবস্থান ধরে রাখতে পাল্টা সমাবেশ করে। ওই শোডাউনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা হয়, ঘটে প্রাণহানিও। পণ্ড হয় বিরোধী দল বিএনপির মহাসমাবেশ। সরকার সমাবেশ পণ্ড করে দিয়েছে দাবি করে বিএনপি রোববার সকাল-সন্ধ্যা হারতাল পালন করে। সোমবার এক দিন বিরতি দিয়ে গত মঙ্গলবার থেকে টানা তিন দিনের অবরোধ পালন করছে বিএনপি-জামায়াত। আওয়ামী লীগও নির্বাচনের তফসিল পর্যন্ত কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজপথে দুপক্ষ মুখোমুখি হলে তা দেশের জন্য শুভ হবে না। এদিকে বিরোধী দলের কর্মসূচি চলাকালে ধরপাকড় হয়, সহিংসতা হয়, সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি অজানা আতঙ্ক দেখা দেয়। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতারা একে অপরকে দোষী দাবি করে বক্তৃতা করছেন। রাজনীতিকদের বাইরেও সাধারণ মানুষ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এ পরিস্থিতি স্বাভাবিক বলে মনে করেন না। পরিস্থিতি উন্নয়নে আলাপ-আলোচনা করে সমাধানের পথ বের করার পরামর্শ এলেও নিজ নিজ অবস্থানে অনড় উভয় পক্ষ। শেষ পর্যন্ত সংলাপের মাধ্যমে পরিস্থিতির উন্নতি না হলে সংকটে পড়বে দেশ, এমন আশঙ্কার কথাও বলছেন বিশ্লেষকরা।
এদিকে গত ৩১ অক্টোবর সকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে বৈঠকে বসেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নিজ কক্ষে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘পরিবেশ প্রতিকূল হলে নির্বাচন করা হবে না, এ ধরনের কোনো ভুল বোঝাবুঝি যেন জনগণের মধ্যে না থাকে।’ সিইসি বলেন, ‘নির্বাচনি পরিবেশ কেমন আছে পিটার হাস সেটি জানতে চেয়েছেন। আমাদের পক্ষ থেকে তাকে স্পষ্ট করে বলেছি, আমাদের হাতে কোনো অপশন নেই। নির্বাচন কমিশনকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী এবং নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্ন ভিন্ন অপশন থাকে। তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতেও পারে, নাও করতে পারে। তারা এককভাবে ৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে, আবার জোট করেও নির্বাচন করতে পারে। তাদের অপশন আছে কিন্তু নির্বাচন কমিশনের সেই ধরনের কোনো অপশন নেই। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, নির্ধারিত পদ্ধতি এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আমরা এ ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থানে আছি।’ অপরদিকে, সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে বৈঠকের পর বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, রাজনৈতিক সংকট নিরসনে দলগুলো শর্তহীনভাবে সংলাপে বসবে এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পথ খুঁজে নেবে। সোয়া ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক শেষে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী আমরা নির্বাচনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা দেখতে চাই।’
ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক গতকাল বুধবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে শেষে মন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, ‘বিএনপির সঙ্গে সরকারের সংলাপের দরজা বন্ধ হয়ে যায়নি, আমরা সংবিধানের কাঠামোর মধ্য থেকে যেকোনো শর্তহীন আলোচনায় রাজি আছি।’ ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে কী আলাপ হয়েছে, সাংবাদিকদের এর প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তেমন কোনো আলাপ হয়নি। তিনি (ব্রিটিশ হাইকমিশনার) বলেছেন, সংকট সমাধানে সংলাপ হচ্ছে প্রধান হাতিয়ার। আমরা বলেছি, আমরা সবসময় সংলাপকে স্বাগত জানাই। সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত বলে আমরাও মনে করি। সংবিধান আমাদের যেভাবে কাঠামো করে দিয়েছে, সেটি অনুসারে সংলাপ করতে হবে। এটি সারাহ কুকও স্বীকার করে নিয়েছেন। তিনিও বলেন, সংলাপের বিকল্প নেই। সব অংশীজনের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করার কথা তিনিও বলেছেন। এটি কোনো পরামর্শ নয়, এটি আমাদের মধ্যে আলাপচারিতা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য সামনে এসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চাই, সহিংসতা চাই না। তিনি আলাপ-আলোচনা করার জন্য সবসময় নির্দেশ দেন, যেন পরিস্থিতি শান্ত থাকে, সেটি আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। আপনারা সংলাপের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন কি-না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, যারা আসবে, তাদের সঙ্গে আমরা কথা বলব। শর্তহীনভাব আসতে হবে। সংবিধানের কাঠামো মেনেই আমাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। সংবিধানের বাইরে যদি কেউ কিছু বলেন, তাহলে তো সেটি হবে না। আপনারা ক্ষমতায় আছেন, বিরোধীদের তো আপনাদের ডাকতে হবে— এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেকেই তো আসছেন। তাদের প্রয়োজনে আমাদের ফোন করছেন। তারা তো বলতে পারেন, আমরা কথা বলতে চাই, আমরা হরতাল চাই না। এটি তো তারা বলেননি কোনোদিন। আমরা তো বলছি, দরজা তো বন্ধ হয়নি। আমরা যেকোনো আলোচনায় রাজি আছি, সেটি সংবিধানের কাঠোমোর মধ্য থেকে।
৩১ অক্টোবর মঙ্গলবার বিকেলে গণভবনে সংবাদ সম্মেলন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে এক সাংবাদিক জানতে চান, মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস নির্বাচন নিয়ে শর্তহীন সংলাপে বসার কথা বলেছেন। এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান কী? বিএনপিকে খুনিদের দল আখ্যা দিয়ে দলটির সঙ্গে সংলাপের বিষয়টি একরকম উড়িয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, কার সঙ্গে সংলাপ করব। খুনিদের সঙ্গে আবার কীসের সংলাপ? জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদ (জানিপপ) চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ মনে করেন, নির্বাচনের আগে উভয়পক্ষ (সরকার ও বিরোধী) আলাপ-আলোচনা করে রাজনৈতিক সংকটের সমাধান করতে না পারলে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, দেশের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারদের সঙ্গে বৈঠক করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের দেয়া বক্তৃতা উদ্ধৃত করে এ রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, ইসির সঙ্গে বৈঠক করে পিটার হাস সংলাপ-সমঝোতার কথা বলেছেন। তিনি এও বলেছেন হিংসাত্মক কার্যকলাপ নিন্দাজনক। তিনি আলোচনার করেই সমস্যা সমাধানের তাগিদ দিয়েছেন। পিটার হাসের বক্তব্য তার ব্যক্তিগত অভিমত নয়, এটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অভিমত। আমার সংবাদের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে প্রফেসর কলিমউল্লাহ আরও বলেন, ২৮ অক্টোবরের ঘটনার (সংঘর্ষ-সহিংসতা) পর বিশ্বের প্রভাবশালী সাতটি দেশ বিবৃতি দিয়েছে, তারা নিন্দা জানানোর পাশাপাশি উদ্বেগও প্রকাশ করেছে। ৩১ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে সংলাপের সম্ভাবনা নাচক করে দিয়েছেন। ফলে একটি অনিশ্চয়তাই রয়ে যাচ্ছে। তবে প্রকৃত অর্থে আলাপ-আলোচনা ছাড়া সমস্যা সমাধান করা মুশকিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ মনে করেন, দেশে চলমান সংকট নিরসনে সংলাপের উদ্যোগ নিতে পারেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, এ এখতিয়ার তার রয়েছে, কিন্তু তিনি এখন এই উদ্যোগ নেবেন বলে মনে হয় না। সংলাপ করার সময়ও হাতে নেই। কারণ, আর মাত্র কয়েক দিন পরই তফসিল ঘোষণা হবে। আমার সংবাদের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে ড. সাব্বির আহমেদ বলেন, নির্বাচনের সিডিউল ঘোষিত হলে বিএনপি নির্বাচনে যাবে বলে মনে হচ্ছে না, ফলে একটি একতরফা নির্বাচন হতে পারে। আর বিএনপি নির্বাচনে না গেলে তারা নির্বাচন ঠেকাতে চাইবে। সে ক্ষেত্রে ভোট যাতে অনুষ্ঠিত না হতে পারে সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করার চেষ্টা করবে বিএনপি। সে ক্ষেত্রে দেশের যাতে নৈরাজ্যকর কোনো পরিস্থিতি তৈরি হতে না পারে সে জন্য পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কাজে লাগাতে হবে।