টাকা দিন, গাড়ি ফেরত নিন

মির্জা মেহেদী তমাল ‘টাকা দিন, গাড়ি ফেরত নিন। আর কোনো কথা নাই। কথা কইবেন, সব হারাইবেন। চুপ থাকবেন, সব পাইবেন।’ গাড়ি চুরি করে নিয়ে যাওয়ার পর মালিকের কাছ থেকে টাকা আদায় করতে মোবাইল ফোনে এভাবেই কথা বলছিল চোরচক্রের একজন। গাড়ির মালিক দুশ্চিন্তায়। টাকা দিয়েও যদি গাড়ি ফেরত না পান। বিশ্বাস রেখে টাকা পাঠাতে বলেছে চোরচক্রের সদস্য। দাবিকৃত টাকা পেলে ফেরত দেওয়া হয় গাড়ি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও ঘটে। গাড়ির মালিক শুধু নয়, সিএনজি মালিকরাও চোর চক্রের কাছ থেকে টাকা দিয়ে গাড়ি ছাড়িয়ে আনার ঘটনা অহরহ। সম্প্রতি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে গাড়ি চোরচক্র। খোদ রাজধানীতে প্রতি মাসে অর্ধ শতাধিক গাড়ি চুরির ঘটনা ঘটছে। চারদিকে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। রয়েছে নিরাপত্তাকর্মীও। তার পরও মুহূর্তের মধ্যেই পার্কিং থেকে হাওয়া হয়ে যাচ্ছে গাড়ি। এমনকি চালককে অজ্ঞান করে, মারধর করে গাড়ি নিয়ে যায় চক্রটি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার মধ্যেই ঘটছে এসব ঘটনা। চুরির তুলনায় গাড়ি উদ্ধারের সংখ্যা খুবই কম। চোরচক্র নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করছে। যে কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পেরে উঠছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। তাই সাধারণত থানা-পুলিশমুখো হতে চান না চুরি যাওয়া গাড়ির মালিকরা। বরং চুরি যাওয়া নিজের গাড়িটি টাকার বিনিময়ে ফিরিয়ে নেন চোরের কাছ থেকে। এক্ষেত্রে চোরেরাই কৌশলে যোগাযোগ করে। রয়েছে চোরের দালালপক্ষ। চোরের কাছ থেকে কমিশনের বিনিময়ে তারা মালিক ও চোরের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে। এই তো কয়েক মাস আগের ঘটনা। মহাখালীর আয়েশা মেমোরিয়াল হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে চা পান করছিলেন গাড়িচালক রফিক বেপারি। এ সময় গুলশান-২ এলাকায় যাওয়ার জন্য দরদাম করছিলেন তিন যাত্রী। ৩০০ টাকা ভাড়ায় যাত্রী নিয়ে যাত্রা করেন রফিক। বনানী রেল ক্রসিং যাওয়ার পর অজ্ঞান হয়ে যান চালক। বিষয়টি গাড়ির মালিক শাহ জামাল জানতে পারেন রাত ১১টায়। চালকের মোবাইলফোন থেকে তার ফোনে কল করে বলা হয়, ‘ভাইজান আপনের গাড়ি আমাদের কাছে। ড্রাইভার বনানী রেলক্রসিং এলাকায় পড়ে আছে। গাড়ি নিতে চাইলে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা রেডি করেন।’ টাকার অঙ্ক নিয়ে দুই দিন রফা-দফা শেষে ৭৫ হাজার টাকায় গাড়ি দেওয়ার সম্মতি মিলে। পুরো টাকাই তিনটি পারসোনাল বিকাশ নম্বরে নেয় চোরচক্র। টাকা দেওয়ার তিন-চার ঘণ্টা পর ফোনে মালিককে বলা হয়, টঙ্গী স্টেশন রোডে যেতে। এভাবে তিনটি স্থান পরিবর্তন করে রাত ৯টার দিকে গাজীপুর এলাকাতেই পাওয়া যায় গাড়িটি। এমন এক চক্রের ৬ সদস্যকে উত্তরা থেকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। চেতনানাশক ট্যাবলেট কৌশলে খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে চালককে অচেতন করে সিএনজি ছিনিয়ে নেওয়াই এদের কাজ। এরা হলেন মোহাম্মদ অলী (২৩), তানভীর ইসলাম (২৪), নুর মোহাম্মদ (৩৭), মো. জাকির ওরফে আকবর (৪৫), তাইজুউদ্দিন ওরফে মজিবুর রহমান (৪৫) ও মো. শিপলু (৩০)। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে মজিবুর টঙ্গীর সিএনজি চোরচক্রের অন্যতম সদস্য। গ্রেফতারের সময় তাদের হেফাজত হতে ২টি চোরাই সিএনজি এবং সিএনজি চোরাই কাজে ব্যবহৃত বিপুল পরিমাণ চেতনানাশক ট্যাবলেট ও গুলের কৌটায় তরল চেতনানাশক ওষুধ উদ্ধার করা হয়। গত শনিবার উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করে ডিবি-উত্তর বিভাগের গুলশান জোনাল টিম। পুলিশ জানতে পেরেছে, তারা সিএনজি চুরির সঙ্গে জড়িত। তারা অভিনব কৌশল প্রয়োগ করে সাধারণত ভোর অথবা গভীর রাতে সিএনজি চুরি করত। প্রথমেই একটি সিএনজিকে টার্গেট করত। তারপর টার্গেট করা সিএনজির চালক কোথাও চা অথবা অন্য কিছু খাওয়ার সময় কৌশলে চেতনানাশক ট্যাবলেট খাইয়ে দিত। এরপর নিজেরাই ওই সিএনজি ভাড়া করে কিছুদূর যাওয়ার পর কোনো অজুহাত দেখিয়ে সিএনজি দাঁড় করাত। কয়েক মিনিটের মধ্যে সিএনজি চালক অচেতন হয়ে পড়লে তারা চালককে রাস্তায় ফেলে দিয়ে সিএনজি নিয়ে পালিয়ে যেত। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন অজ্ঞাত ফোন নম্বর ব্যবহার করে সিএনজি মালিকের নিকট বিকাশের মাধ্যমে টাকা দাবি করত। তারা ৭ থেকে ১০ দিন সময় নিয়ে সিএনজি মালিকের কাছ থেকে টাকা আদায়ের চেষ্টা চালায়। চোরাই সিএনজি ফেরত দিতে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত নিত। টাকা পাওয়ার পর কোনো প্রত্যন্ত এলাকায় সিএনজি রেখে মালিককে ফোন করে জানিয়ে দিত। পুলিশ জানায়, সিএনজি বা গাড়ি চালকদের কোনোভাবেই রাস্তার পাশের চায়ের দোকান থেকে চা পান বা অন্য কিছু খাওয়া উচিত নয়। রাস্তার পাশের দোকান বা টং দোকানের আশপাশেই এই চক্রের সদস্যরা ওতপেতে থাকে। সুযোগ পেলেই তারা তা কাজে লাগায়।

Others শীর্ষ সংবাদ