সাকিব গার্মেন্টসে অল্প বেতনে চাকরি করে। পরিবারের খরচ, মায়ের ওষুধ, বাসাভাড়া, খাবার খরচ বাদে সঞ্চয় তেমন কিছুই থাকে না। একটি মোবাইল ক্রয়ের জন্য দীর্ঘ দেড় বছরের জমানো ৩৬ হাজার টাকার সাথে ১৪ হাজার টাকা ধার করে একটি স্যামসাং গ্যালাক্সি সিরিজের মোবাইল ক্রয় করেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ গার্মেন্টস থেকে বাসায় ফেরার পথে বাসের জানালা দিয়ে ছোঁ মেরে ফোনটা নিয়ে চলে যায় ছিনতাইকারী।
এ চক্রের অন্যতম সদস্য আলাউদ্দিন বাবলু ওরফে জাপান বাবু ও আলী দুই বন্ধু। মূলত নেশার টাকার জন্য এসব করে তারা। সন্ধ্যা থেকেই বাস টার্মিনালে ছিনতাইয়ের টার্গেটে থাকে দুজন। এভাবেই টার্গেটকৃত সাকিবের মত অনেকের মোবাইল ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছোঁ মেরে মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে যায়। ছিনতাই চক্রের মূলহোতা আল-আমিনের সাথে ডিল করতে মোবাইল নিয়ে হাজির ছিনতাইকারী চক্রের লিডার দীপু। রাজধানীর নামকরা শপিংমল যমুনা ফিউচার পার্কে আল-আমিনের আটটি নিজের দোকান আছে। সেসব দোকানেই ছিনতাই মালামালের লেনদেন করেন। আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারদের মাধ্যমে আইএমইআইসহ মোবাইলের চেহারা নিমিষে পরিবর্তন করে তারা। ফলে পুলিশও খুঁজে পায় না। অনেকে দামদর করে সাকিবের মোবাইলটি ১৪ হাজার টাকায় বিক্রি করে চক্রসদস্য শুভ। মার্কেটে তার আধিপত্য এতটাই বেশি যে কেউ তার সাথে লাগতে আসে না। তার দোকানে ব্র্যান্ড মালের পাশাপাশি নতুন বক্সে পুরাতন মোবাইলও বিক্রি করে। সবশেষে বিভিন্ন হাতঘুরে চক্রের মূলহোতা আল-আমিনের দোকানে গার্মেন্টস কর্মী সাকিবের মোবাইলটির দাম ওঠে ৩০ হাজার টাকা। তাছাড়া ছিনতাই চক্রের অন্য এক মূলহোতা শাহজাহান একই কায়দায় বসুন্ধরা সিটিতে বিক্রি করছে এসব চোরাই মোবাইল।
চক্রের আরেক সদস্য ইউনুস আলী শুভ ওরফে ডিজে শুভ চিনতাইয়ের বড় চালান না পেয়ে চিন্তিত। ওইদিকে তার বস বড় চালান রেডি করতে চাপ দিচ্ছে। এমন সময় জাপান-বাবু আর আলী দৌড়ে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। তাদের হাতে দামি মোবাইল দেখে ডিজে মহাখুশি। তাদের পাঁচ হাজার টাকা দিলেও সে তার বস থেকে আদায় করে ১০ হাজার টাকা। দুই দিন পরই শুভর বস দীপুর সাথে দেখা করে। সেখানে তার মতো বিভিন্ন এলাকার আরও চার-পাঁচজনকে দেখতে পায়। প্রত্যেকেই আলাদাভাবে কথা বলে ছিনতাইয়ের পণ্যের দাম বুঝে নেয়। সে বসের (দীপু) সাথে কথা বলে সাকিবের মোবাইলটি ১২ হাজারের বিনিময়ে বিক্রি করে।
ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) সূত্র জানায়, বিশেষ অভিযানে গত ৩০ অক্টোবর ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগের নেতৃত্বে মূল মাস্টার মাইন্ডসহ মোট পাঁচজন সক্রিয় মোবাইল চোর চক্রের সদস্যকে শতাধিক মোবাইলসহ উত্তরখান ও যমুনা ফিউচার পার্ক মার্কেট হতে গ্রেপ্তার করেন। সেই সাথে উদ্ধার করা হয় বিপুল পরিমাণে চোরাই মোবাইল ও ল্যাপটপ সাথে আইএমইআই কাটার যন্ত্র।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলো— মো. আল আমিন, দীপু, আলাউদ্দিন বাবলু ওরফে জাপান বাবু, আলী বেপারী, ইউনুছ আলী ওরফে শুভ। গ্রেপ্তারকৃতরা জানায়, তারা মোবাইল চোরাই চক্রের সক্রিয় সদস্য। পরস্পর যোগসাজশে দীর্ঘদিন যাবৎ চোরাই মোবাইল সংগ্রহ, মজুত, ক্রয়-বিক্রয় করে আসছে। রাজধানীর ঢাকার বিভিন্ন স্পটে তারা সংঘবদ্ধ চুরি ছিনতাইসহ নানা অপারাধে জড়িত। এ চক্রের সদস্য আলাউদ্দিন বাবলু ওরফে জাপান বাবু এবং আলী ব্যাপারীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে উত্তরা, আব্দুল্লাহপুর, টঙ্গী এলাকা। দীর্ঘদিন যাবৎ চুরি, ছিনতাই ও পকেটমারের মতো অপরাধ করে। তারা বিভিন্ন রাস্তায়, যানবাহনে মোবাইল ছিনতাই করে। এগুলো ইউনুছ আলী ওরফে শুভর কাছে ব্র্যান্ডভেদে চার থেকে ছয় হাজার টাকায় বিক্রি করে চক্রটি। পরবর্তীতে শুভ বিক্রি করে দীপুর কাছে আট থেকে ১০ হাজারে।
এভাবে সংগ্রহ করে সপ্তাহান্তে দীপু, শুভ, শরীফ, শ্যামলসহ অন্যদের কাছ থেকে বিভিন্ন রকমের ছিনতাইকৃত মোবাইল, ল্যাপটপ, ডিএসএলআর ক্যামেরা ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী ১২ থেকে ১৪ হাজারে ক্রয় করে মাস্টারমাইন্ড আল-আমিন এবং শাহজাহান। আল-আমিনের যমুনা ফিউচার পার্কে মোবাইলের দোকান রয়েছে এবং শাহজাহানের বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সে মোবাইলের দোকান রয়েছে। আল-আমিন এসব মোবাইল ক্রয় করে নিজস্ব ল্যাপটপ ও সফটওয়ারের মাধ্যমে আইএমইআই পরিবর্তন করে ব্যবহূত সেকেন্ড হ্যান্ড ফোন হিসেবে নিজেদের দোকানে ২৫ থেকে ৩০ হাজারে সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করে।
এছাড়াও সে ভারত, দুবাই, মালয়েশিয়া ও অন্যান্য দেশ থেকে চোরাই মোবাইল বাংলাদেশে এনে বিক্রি করে। এসব মোবাইল চুরি রোধে করণীয় বিষয়ে জানতে চাইল গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন বলেন, গাড়িতে, রাস্তায় অথবা বাইরে চলাচলের সময় সর্তকতার সঙ্গে মোবাইল ব্যবহার করতে হবে। কোনো কিছু চুরি বা ছিনতাই হলে সাথে সাথে নিকটস্থ থানায় জানাতে হবে। পুরনো ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস ক্রয়ের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
জানতে চাইলে গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি) সাইফুর রহমান আজাদ বলেন, ‘এখন জিডি করে আর মানুষ তার ফোনগুলো পায় না। কারণ ফোন চুরি হওয়ার সাথে সাথে চোরচক্র আইএমইআই কাটার দিয়ে আইএমআই চেঞ্জ করে ফেলে। একটি ফোন মানুষের অনেক আবেগের জায়গা। সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধচক্রে ছিনতাইকারী থেকে শুরু করে যমুনা ফিউচার পার্কে দোকানের মালিকসহ যারা চোরাই ফোন বিক্রি করে পুরো চক্রটিকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের চোরাই ফোন ইন্ডিয়াতে চলে যায় ইন্ডিয়ার ফোন বাংলাদেশে আসে। এ বিষয়গুলোতে জনসাধারণকে সচেতন করা প্রয়োজন। আনঅথরাইজ ফোন অথবা চোরাই ফোন অথবা পুরাতন ফোন ক্রয়ের ক্ষেত্রে সবার সতর্ক থাকা উচিত।’