নিজস্ব প্রতিবেদক
আন্দোলন কর্মসূচিতে কিভাবে এবং কী ধরনের বৈচিত্র্য আনা যায় তা নিয়ে ভাবছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। টানা অবরোধ বা হরতাল পালন করলে মানুষের মধ্যে একঘেয়েমি তৈরি হতে পারে। কর্মীদের মধ্যে আসতে পারে শৈথিল্য। আবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে-পরে কর্মসূচি তীব্রতর করতে চায় দলটি।
বিএনপিতাই এসব কর্মসূচির পাশাপাশি আর কী করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে বলা হয়েছে বর্তমানে সক্রিয় আছেন এমন নেতাদের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতা এ তথ্য জানিয়েছেন।
গত সপ্তাহে হরতাল-অবরোধের পর আজ রবিবার ভোর থেকে বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলোর ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ শুরু হচ্ছে। এরপর এক দিন বিরতি দিয়ে বুধ ও বৃহস্পতিবার হরতাল কিংবা অবরোধ দিতে পারে দলটি।
এর পরের সপ্তাহে কী কর্মসূচি দেওয়া যায়, তা নিয়ে ভাবছেন নীতিনির্ধারকরা। তবে অবরোধে মিছিলের পাশাপাশি পিকেটিং বাড়াতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
নতুন কর্মসূচির বিষয়ে গত দুই দিন বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। সেখানে অবরোধ রেখে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ ভবন ঘেরাও, অবস্থান ও অসহযোগ আন্দোলনের মতো বিষয়ে প্রস্তাব এসেছে।
তবে বেশির ভাগ নেতা অসহযোগের মতো কর্মসূচিকে উপযুক্ত মনে করছেন না বলে মত দিয়েছেন।
দলের কর্মকৌশল প্রণয়নে ভূমিকা রাখেন এমন নেতারা বলেন, অসহযোগ আন্দোলন করার পরিস্থিতি এখন দেশে নেই। সরকারকে অসহযোগিতা করে কর্মস্থলে না যাওয়া, কলকারখানা বন্ধ রাখা কিংবা অফিস-আদালত বন্ধ রাখার মতো বাস্তবতা নেই। আর গুরুত্বপূর্ণ ভবন ঘেরাও করতে হলে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীকে জড়ো করতে হবে। গ্রেপ্তার এড়াতে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের গাঢাকা দেওয়া, তাও কঠিন।
তবে অবরোধ রেখে ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি দেওয়ার প্রস্তাব একেবারে নাকচ করে দেননি নীতিনির্ধারকরা।
বৈঠকে নেতারা তাঁদের মতামত দিতে গিয়ে বলেন, গত ২৮ অক্টোবর উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং পরে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির আরো দুই নেতাসহ দলের অসংখ্য নেতাকর্মী গ্রেপ্তারের ঘটনার পর কঠোর কর্মসূচি ছাড়া বিকল্প নেই। তাঁরা মনে করেন, ২৮ অক্টোবর সরকার পরিস্থিতি তৈরি করে বিএনপিকে হরতাল-অবরোধের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এখন তফসিল ঠেকাতে হলে বড় কর্মসূচি চালাতে হবে। নেতাদের কারো কারো মতে, টানা অবরোধ চালিয়ে যেতে হবে। মাঝে মাঝে হরতাল দেওয়া যেতে পারে।
গত সপ্তাহে এক দিন হরতাল ও তিন দিনের অবরোধের বিষয়ে দলের নীতিনির্ধারকদের মূল্যায়ন হচ্ছে, কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষের সাড়া পাওয়া গেছে। মানুষ দোকানপাট খোলেনি। প্রয়োজন ছাড়া বাসাবাড়ি থেকে কম বের হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন এ ধরনের কর্মসূচিতে থাকলে জীবিকার তাগিদে মানুষ ঘর থেকে বের হয়ে আসবে। সে ক্ষেত্রে কর্মসূচি ঢিলেঢালা হয়ে পড়বে।
তবে আজ থেকে অবরোধ কর্মসূচি যাতে ভালোভাবে পালিত হয়, এ জন্য বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা ভার্চুয়াল সমন্বয়সভা করেছেন। এতে মিছিলের পাশাপাশি পিকেটিং বাড়াতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। কঠোর কর্মসূচি থেকে আমরা পিছু হটব না।’
শুরু হচ্ছে ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ
বিএনপির ঘোষণা অনুযায়ী আজ ভোর ৬টা থেকে টানা ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি শুরু হচ্ছে। আগামী মঙ্গলবার ভোর ৬টায় কর্মসূচি শেষ হবে। ৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে বিরতি দিয়ে পরের দুই দিন আবার কর্মসূচি দেওয়া হবে। জামায়াতে ইসলামীও দুই দিনের অবরোধ ডেকেছে। বিএনপির সমমনা দলগুলোও অবরোধে সমর্থন দিয়ে মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে চট্টগ্রামে এবং ময়মনসিংহ বিভাগীয় কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক শরিফুল আলমকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে কিশোরগঞ্জে অবরোধের পাশাপাশি হরতাল পালন করবে দলটি।
গ্রেপ্তারের কারণে নতুন দায়িত্বে যাঁরা
দায়িত্বশীল নেতারা গ্রেপ্তার হওয়ায় তাঁদের অনুপস্থিতিতে কারা দায়িত্ব পালন করবেন তা দল থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপনকে গ্রেপ্তারের কয়েক ঘণ্টার মাথায় সেলের সদস্য অধ্যাপক ডা. মওদুদ হোসেন আলমগীরকে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে নরসিংদী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক খায়রুল কবির খোকন কারাগারে থাকায় তাঁর স্থলে কমিটির সদস্য সাখাওয়াত হোসেন বকুলকে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক করা হয়েছে। নরসিংদী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসচিব মঞ্জুর এলাহী আটক হওয়ায় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক আবু সালেহ চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সদস্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির সভাপতি সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমী এবং সাধারণ সম্পাদক সোহরাব উদ্দিন কারাগারে রয়েছেন। কমিটির সহসভাপতি কুতুব উদ্দিনকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী জাকির হোসেন সরকারকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে।
দিনাজপুর জেলা বিএনপির সভাপতি মোফাজ্জল হোসেন দুলালের অনুপস্থিতিতে সিনিয়র সহসভাপতি মোকাররম হোসেনকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, গাইবান্ধা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুন্নবী টিটুল গ্রেপ্তার হওয়ায় প্রথম যুগ্ম সম্পাদক মো. ইলিয়াস হোসেনকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক, রংপুর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক শামসুজ্জামান সামু গ্রেপ্তার হওয়ায় প্রথম যুগ্ম আহ্বায়ক শহিদুল ইসলাম মিজুকে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক, সদস্যসচিব অ্যাডভোকেট মাহফুজ উন নবী ডন গ্রেপ্তার হওয়ায় সদস্য আব্দুস সালামকে ভারপ্রাপ্ত সদস্যসচিব এবং নড়াইল জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম গ্রেপ্তার হওয়ায় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাজী সুলতানুজ্জামান সেলিমকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
দ্বিতীয় দফা অবরোধ শুরুর আগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান বলেন, মামলা-হামলা আর গ্রেপ্তার করে বিএনপিকে নেতৃত্বশূন্য করা সম্ভব নয়। যেখানে যিনি গ্রেপ্তার হচ্ছেন সেখানে বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি হয়ে যাচ্ছে।
কর্মসূচি পালনে সমন্বয় আনছে শরিকরা
বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী দলগুলো এখন থেকে একই দিনে একই সময়ে কাছাকাছি দূরত্বে অবস্থান নিয়ে কর্মসূচি সফলে মিছিল ও পিকেটিং করবে। সম্প্রতি বিএনপির সঙ্গে আলাপ করে শরিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে বৈঠক করে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে।
শরিক দলগুলোর সূত্র জানায়, গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য এবং গণফোরাম (মন্টু) ও বাংলাদেশ পিপলস পার্টি (বিপিপি) কর্মসূচি বাস্তবায়নে নতুন এই উদ্যোগের সঙ্গে একমত হয়েছে। আন্দোলন পরিচালনার লক্ষ্যে শিগগিরই জোটগুলোর সমন্বয়কারীদের নিয়ে একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হবে।
ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে চলমান আন্দোলন চাঙ্গা ও গতিশীল করতে শরিক জোটগুলোর সমন্বয়ে নতুন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
রক্ত ঝরিয়ে একতরফা নির্বাচন চায় সরকার : রিজভী
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী অভিযোগ করেছেন, সরকারের লোকেরা ক্ষমতার এতটাই স্বাদ পেয়েছে যে রক্ত ঝরিয়ে হলেও তারা একতরফা নির্বাচন করবে।
রিজভী অভিযোগ করে বলেন, ‘বিএনপিকে বল প্রয়োগে উত্খাতের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। বাংলাদেশে এখন একাত্তরের ভয়াল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। একাত্তরে হানাদার বাহিনীর হিংস্রতা ও দুঃশাসন হুবহু নকল করছে আওয়ামী সরকার। পাকিস্তানের শান্তি কমিটির মতো এখন আওয়ামী লীগ শান্তি সমাবেশ করছে। হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের না পেলে তাঁদের পরিবারের লোকদের ধরে নিয়ে যেত। আওয়ামী পুলিশ সেই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করছে। ছেলে না পেলে তার ভাইকে, ভাইকে না পেলে তার বাবাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। সারা দেশ থেকে এই অমানবিক মনুষ্যত্বহীন সংবাদ প্রতিনিয়ত আমাদের শুনতে হচ্ছে।’