নিজস্ব প্রতিবেদক
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ২৬ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে একদিনে সংলাপ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে বিএনপিসহ ১৮ রাজনৈতিক দল এই সংলাপে অংশ নেয়নি। সংলাপে অংশ নিয়ে ভোটের পরিবেশ ভালো রয়েছে বলে দাবি করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তবে ভোটের অনুকূল পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে কয়েকটি দল।
গতকাল শনিবার আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে দুই পর্বে ১৩টি করে দলের সঙ্গে সংলাপে বসে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন ইসি। এতে প্রতিটি দলের দুজন করে প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। এ সময় চার নির্বাচন কমিশনার, ইসি সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ‘স্পেস ও টাইম’ সীমিত উল্লেখ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর বিবদমান সংকট নিরসনে নির্বাচন কমিশনের কোনো ম্যান্ডেট নেই। দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সংকটের সমাধান করে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে।
কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, আমরা মতবিনিময় করেছি, যাতে আগামী নির্বাচনটা সবার অংশগ্রহণে সক্রিয় দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়। আমি এককভাবে সব করে দেব তা নয়, তাদেরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। আশা করি সবাই উজ্জীবিত হবে, উদ্বুদ্ধ হবে এবং সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী হবে।
নির্বাচনে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে প্রার্থীদের পোলিং এজেন্ট নিয়োগের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সিইসি বলেন, পোলিং এজেন্ট যদি বিক্রি হয়ে যায়, আমার করার কিছু থাকবে না। পোলিং এজেন্ট যদি আপনাদের (প্রার্থী) প্রোটেক্ট (রক্ষা) করতে না পারে, আমরা ঢাকা থেকে পারব না।
সংলাপে অংশ নেন আওয়ামী লীগের দুই প্রতিনিধি। পরে দলটির নেতা ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব) ফারুক খান বলেন, বিএনপিকে নিয়ে নির্বাচন করতে হবে এ কথা সংবিধানে লেখা নেই, কোনো আইনে লেখা নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমরা দেখেছি, নির্বাচনের সময় অনেক রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নেয় না। যাদের ক্যাপাসিটি নেই, যাদের জনসমর্থন নেই, জনগণের প্রতি আস্থা নেই, তারা নির্বাচনে আসবে না।
সংলাপ শেষে সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে ব্রিফিং করা হয়নি। জানতে চাইলে বৈঠকে উপস্থিত জাপা প্রতিনিধি প্রেসিডিয়াম সদস্য রেজাউল ইসলাম ভুঁইয়া জানান, বরাবরের মতো ইসির সব ধরনের প্রস্তুতি জানানো হয়েছে।
সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বলেন, সংসদ নির্বাচন যাতে অংশগ্রহণমূলক হয়, অবাধ ও সুষ্ঠু হয় এবং এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণ যাতে তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে, সে ব্যাপারে কমিশনকে অর্থবহ পদক্ষেপ নিতে হবে। পেশিশক্তি, সন্ত্রাসের দাপটমুক্ত ও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন যেন না হয়, সে বিষয়ে নজর দিতে বলেছে সাম্যবাদী দল।
তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমূর আলম খন্দকার বলেন, নির্বাচনে জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য কমিশনকে আরও কাজ করতে হবে। জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মোমিনুল আলম বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সিইসি রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর যেভাবে দায়িত্ব চাপিয়েছেন, তাতে ফেরেশতারা ছাড়া আওয়ামী লীগের ক্যাডার বাহিনী মোকাবিলা করে নির্বাচনে টিকে থাকা সম্ভব না। রাজনৈতিক ঐকমত্য সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত এবং নির্দলীয় সরকারব্যবস্থার দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তফসিল ঘোষণা স্থগিতের দাবি জানিয়েছি।
ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের চেয়ারম্যান সৈয়দ বাহাদুর শাহ মোজাদ্দেদী বলেন, বাংলাদেশের মানুষ ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো প্রহসনের নির্বাচন আর দেখতে চায় না। আমরা চাই- অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন। বাংলাদেশ কংগ্রেসের সভাপতি অ্যাডভোকেট কাজী রেজাউল হোসেন বলেন, নির্বাচনে প্রার্থী ও ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রস্তাব করেছি।
বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) সভাপতি এসএম আবুল কালাম আজাদ বলেন, ইসির অধীনে নির্বাচন হবে, সরকারের অধীনে নয়। নির্বাচনের পরিবেশ ঠিক করতে কমিশনকে বলা হয়েছে। ইনসানিয়াত বিপ্লবের মহাসচিব রায়হান রাহবার সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে নির্বাচন পরিচালনার প্রস্তাব দেন।
গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মো. মিজানুর রহমান বলেন, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার জন্য ইসির ওপর আস্থা থাকলেও দলীয় ও সরকারের আজ্ঞাবহ প্রশাসনের কারণে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে সংশয় আছে। গণফ্রন্টের চেয়ারম্যান মো. জাকির হোসেন জানান, জাতীয় সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়, নির্বাচনকালীন রাজনৈতিক সরকার চাই।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সভাপতি আইভি আহমেদ বলেন, আগামী নির্বাচনের দিকে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি রয়েছে। কমিশন জানিয়েছে, নির্বাচনে পুরোপুরি অনুকূল পরিবেশ তেমন নেই। তবে সবসময় সম্পূর্ণ অনুকূল পরিবেশে নির্বাচন করব সেটিও না; ৯৯ ভাগ পরিবেশ অনুকূল হবে, সেটিও বলতে পারি না। অনুকূল পরিবেশ না থাকলেও তার মধ্য দিয়ে আমাদের নির্বাচন করে যেতে হবে।
তরিকত ফেডারেশনের মুখপাত্র মোহাম্মদ আলী ফারুকী দলের পক্ষ থেকে সংবিধান যে ক্ষমতা দিয়েছে তা নির্বাচন কমিশনকে প্রয়োগ করে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য মোশাররফ হোসেন বলেন, যারা আলোচনায় আসেনি নির্বাচন কমিশন উদ্যোগ নিয়ে তাদের আলোচনায় নিয়ে আসা। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে কমিশনকে এই উদ্যোগ নিতে হবে।
বিকল্পধারার মহাসচিব আবদুল মান্নান বলেন, এর আগে এগারোটা নির্বাচন হয়েছে। সব নির্বাচনে ছোটখাটো ভুল ছিল। আমাদের প্রস্তাব ছিল- আগামী নির্বাচনে যেন কোনো ভুলত্রুটি না হয়। আইনের শাসন আমরা চাই। সবার যদি অংশগ্রহণ না হয়, সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হয়, তা হলে নির্বাচন ও সংসদ জনগণের বা দেশের কাজে আসবে না।
সংলাপে অংশ নিতে ইসি আমন্ত্রণ জানালেও সাড়া দেয়নি বিএনপি। গত বছর ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করে ইসি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ তৈরির আগেও সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আরেক দফা সংলাপ করে কমিশন। দুবারই বিএনপি সংলাপ বয়কট করে। সবশেষ ধাপের সংলাপও বর্জন করেছে দলটি।
গতকাল সকালে ইসির বৈঠকে ডাকা হয়েছিল- আওয়ামী লীগ, ইসলামী ঐক্যজোট, এলডিপি, তৃণমূল বিএনপি, এনডিএম, বাংলাদেশ কংগ্রেস, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বিজেপি, সিপিবি, বাংলাদেশ মুসলীম লীগ, এনপিপি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, গণফোরাম, গণতন্ত্রী পার্টি, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি, খেলাফত মজলিশ, বিএমএল, বিএনএফ, গণফ্রন্ট ও ইনসানিয়তা বিপ্লব বাংলাদেশকে। এর মধ্যে বৈঠকে উপস্থিত হয়নি- বিএনপির সমমনা এলডিপি, বিজেপি, কল্যাণ পার্টি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, সিপিবি, গণতন্ত্রী পার্টি, বিএমএল, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, খেলাফত মজলিশ।
বিকালে আলোচনায় যোগ দেয় সাম্যবাদী দল, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ, বিএনএম, ইসলামিক ফ্রন্ট, তরিকত ফেডারেশন, জাকের পার্টি, জাতীয় পার্টি, বিকল্পধারা, বাংলাদেশ ন্যাপ, জেপি, সংস্কৃতিক মুক্তিজোট, ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি।
বিকালে ৯ দল ইসির সঙ্গে ওই আলোচনায় অংশ নেয়নি। এগুলো হলো- বিএনপি, জেএসডি, বাসদ, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ জাসদ।