রেজাউল করিম হীরা
দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে উত্তপ্ত রাজপথ। নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে বিএনপি-জামায়াতের ডাকা অবরোধ কর্মসূচিকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘাত সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। পাশাপাশি চোরাগোপ্তা হামলা ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনাও বাড়ছে।
নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসায় নাশকতা ও সহিংসতা আরও বাড়তে পারে বলে সরকার আশঙ্কা করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়েছে নানাবিধ পদক্ষেপ। রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘিরে জ্বালাও-পোড়াও শুরু হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। ফলে সব ধরনের নাশকতা প্রতিরোধে বিশেষ নজর রাখছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশ ঘিরে সহিংসতা সূত্রপাত হয়। ওই দিন সহিংসতায় এক পুলিশ সদস্য ও এক যুবদল কর্মী নিহত হয়। পুলিশ ও বিএনপির নেতাকর্মীদের সহিংসতায় রাজধানীর নয়া পল্টন ও কাকরাইল এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এ ঘটনার পর এক দিন হরতালের ডাক দেয় বিএনপি-জামায়াত।এরপর থেকে অবরোধ কর্মসূচি পালন করে আসছে বিরোধীদলগুলো। এই কর্মসূচিকে ঘিরে চোরাগোপ্তা হামলা ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে। দুই দফা অবরোধে অর্ধশতাধিক যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করেছে দূবৃত্তরা। এসব কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। এই পরিস্থিতিতে সরকার সার্বিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দিতে চায় না বলে জানা গেছে। যার ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে সরকারের নির্দেশে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা।
নাশকতার বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছে। দুষ্কৃতকারীদের গ্রেপ্তারসহ যা যা করা দরকার তা-ই শতভাগ করছে। জনগণের জানমাল নিরাপত্তায় যা যা করা দরকার, তা-ই করব।’
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, অবরোধ কেন্দ্র করে রাজধানীবাসীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার লক্ষ্যে দুই ভাগে ভাগ করে দায়িত্ব পালন করছেন ২০ হাজার পুলিশ সদস্য। তার মধ্যে দিনে প্রায় ১১ হাজার এবং রাতে প্রায় ৯ হাজার পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। দায়িত্ব পালন করছেন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তারাও। মাঠ পর্যায়ে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা যে কোনো পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক নির্দেশ যেন পেতে পারেন, এ লক্ষ্যে এবারই প্রথম রাতে উপ-পুলিশ কমিশনাররা (ডিসি) দায়িত্ব পালন করছেন।
ডিএমপির আটটি ক্রাইম ডিভিশনে একজন করে উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) এ দায়িত্ব পালন করছেন। এর বাইরে নিয়মিত দায়িত্ব পালনে প্রতিদিন একজন অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া চোরাগোপ্তা হামলা ও যানবাহন ভাঙচুর করে কেউ যেন পালিয়ে যেতে না পারে- সেজন্য রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে সাদা পোশাকের পুলিশ।
গণপরিবহনে চোরাগোপ্তা হামলার বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) ড. খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের বড় সমস্যা চোরাগোপ্তা হামলা। যাত্রীবেশে বাসে আগুন দিচ্ছে দুর্বৃত্তরা। এরই মধ্যে আমরা দুই জায়গা থেকে দুটি গ্রæপ গ্রেফতার করেছি। এসব হামলাকারীকে ধরতে আমাদের গোয়েন্দা ও পুলিশ সদস্যরা সার্বক্ষণিক নজরদারি রাখছেন।
অবরোধের মধ্যে যারা যানবাহনে আগুন দিচ্ছে ও পেট্রলবোমা মারছে, তাদের ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করেছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান। গতকাল ডিএমপির সঙ্গে পেট্রল পাম্প মালিক সমিতির নিরাপত্তা ব্যবস্থা সংক্রান্ত এক মতবিনিময় সভায় তিনি এ ঘোষণা দেন।
ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘বিভিন্ন সময় সন্ত্রাসীরা গাড়িতে আগুন দিয়ে দুর্ভোগ সৃষ্টি করছে, সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করছে। যারা আগুন দিয়ে দেশে আরাজকতা সৃষ্টি করে, হত্যা করে, তাদের ধরিয়ে দিলে বা তথ্য দিলে ২০ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।’
হাবিবুর রহমান আরও বলেন, ‘বিভিন্ন স্থানে যারা গাড়িতে আগুন দিচ্ছে, পেট্রলবোমা মারছে, সহিংসতা ও নাশকতা করছে তাদের অনেককে আমরা হাতেনাতে গ্রেপ্তার করেছি। অনেক প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়রা পুলিশের হাতে তাদের ধরিয়ে দিয়েছেন।’
পুলিশের পাশাপাশি র্যাব, বিজিবি, আনসার-ভিডিপিসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও নাশকতা রোধে কাজ করছে। সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে র্যাব ও বিজিবির বিপুল সংখ্যক সদস্য মাঠে নামানো হয়েছে। গতকাল সকাল থেকেই সড়ক-মহাসড়ক ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় তাদের টহল দিতে দেখা গেছে।
অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে জনগণের জানমাল রক্ষায় ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে র্যাবের ৪৬০টি টহল টিম মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া দূরপাল্লার বাসেও নিরাপত্তা দিচ্ছে র্যাব।
গতকাল সকালে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে রাজধানীতে র্যাব ফোর্সেসের ১৬০টি টহল টিম মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া ঢাকাসহ সারা দেশে ৪৬০টি টহল টিম মোতায়েন রয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা সম্মিলিত টহল দিচ্ছি ও গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত আছে। পাশাপাশি পণ্য ও যাত্রীবাহী পরিবহনের জন্য ব্যবস্থা নিয়েছি। বিভিন্ন দূরপাল্লার পরিবহনের মালিকদের সঙ্গে সমন্বয় করছি। দূরপাল্লার বাসগুলোকে একটি নির্দিষ্ট সময়ে স্কট দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাজধানীসহ সারাদেশে ২২৮ প্লাটুন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম।
নাশকতা প্রতিরোধে সারাদেশে এক হাজার ৪৭৬ পয়েন্টে ১০ হাজার আনসার-ভিডিপি সদস্য কাজ করছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর উপ-পরিচালক (প্রকল্প- প্রশিক্ষণ) ও গণসংযোগ কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. জাহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘রেলওয়ে স্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চঘাটসহ সরকারি ও বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এবং জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানের নিরাপত্তায় আনসার ও ভিডিপি সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন। রেললাইনে যে কোনো ধরনের নাশকতা প্রতিরোধে সারাদেশে এক হাজার ৪৭৬ পয়েন্টে ১০ হাজার আনসার-ভিডিপি সদস্য কাজ করছেন। এছাড়া সরকারি ও বেসরকারি ৫ হাজার ২৯৬ প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তায় ৫৫ হাজার অঙ্গীভ‚ত আনসার নিয়োজিত রয়েছেন।