নিজস্ব প্রতিবেদক ঢাকা
নানা ধরনের ছাড় দেওয়ার কারণে ঋণখেলাপিদের নির্বাচনে অংশ নেওয়া সহজ হয়ে গেছে। এখন আর ভোটে দাঁড়াতে আগের মতো ১০ শতাংশ নগদ অর্থ জমা দিয়ে ঋণ পুনঃ তফসিল করতে হচ্ছে না। এর চেয়ে অনেক কম অর্থ জমা দিলেই হয়। তা ছাড়া আগের মতো ঋণ পুনঃ তফসিলের প্রস্তাবও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠানোর দরকার পড়ে না। ফলে ব্যাংকগুলো যে যার মতো করে খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিল করে দিচ্ছে।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২–এর ১২ অনুচ্ছেদের বিধান অনুসারে কোনো ঋণখেলাপি ব্যক্তি জাতীয় সংসদের সদস্য হওয়ার যোগ্য হন না। ফলে খেলাপি হলে কেউ প্রার্থী হতে পারেন না। আগে নিয়ম ছিল মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সাত দিন আগে খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিল করে নিয়মিত করতে হবে। ব্যাংকঋণ পরিশোধসংক্রান্ত বিধান ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে সংশোধন করা হয়। আর বিলখেলাপি–সংক্রান্ত বিধান সংশোধন করা হয় চলতি বছরের জুলাইয়ে। নতুন আইনে মনোনয়নপত্র জমার এক দিন আগে খেলাপি ঋণ পরিশোধ করলেই নির্বাচনে অংশ নেওয়া যায়।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি) ঋণখেলাপিদের আরও ছাড় দিতে চেয়েছিল। ঋণখেলাপিদের জন্য নির্বাচনের পথ সহজ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ তথ্য ব্যুরো (সিআইবি) ছাড়পত্রের বাধ্যবাধকতা তুলে দিতে চেয়েছিল ইসি। তারা চেয়েছিল খেলাপি ঋণ আদায়ে কেবল মামলা থাকলেই নির্বাচনে অযোগ্য হবেন। এ জন্য সিআইবির ছাড়পত্র লাগবে না। তাই গত বছরের জুলাই মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে ইসি বৈঠক করে। কিন্তু ব্যাংকগুলো তাতে সম্মতি দেয়নি।
২০১৮ সালে ব্যাংকঋণ পরিশোধসংক্রান্ত বিধান, আর এ বছর বিলখেলাপি–সংক্রান্ত বিধান সংশোধন করায় এমন সুযোগ তৈরি হয়েছে।
যেভাবে ছাড় দেওয়া হলো
করোনাভাইরাসের কারণে দুই বছরের বেশি সময় ঋণ পরিশোধে ছাড় দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন ঋণ শোধ বা কিস্তি না দিলেও কেউ খেলাপি হননি। এরপর গত বছরের জুলাইয়ে খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিলের নীতিমালা সংশোধন করে ছাড় দেওয়া হয়। যার ফলে এখন ব্যাংক নিজেই খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে পারছে। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে এখন জমা দিতে হচ্ছে বকেয়ার আড়াই থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ৬ শতাংশ অর্থ। আগে যা ছিল ১০ থেকে ৩০ শতাংশ। এই নীতিমালার আওতায় সম্প্রতি জনতা ব্যাংকের গ্রাহক বেক্সিমকো ও এস আলম গ্রুপ তাদের ঋণ নিয়মিত করেছে।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, এই নিয়মের ফলে ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ছে। এ জন্য উচ্চ সুদে আমানত নিতে হচ্ছে। ঋণের কিস্তি আদায়ও কমে গেছে।
খেলাপি ঋণসংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জুন শেষে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি ৩৯ টাকা, যা সেপ্টেম্বর শেষে কমে হয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা। এর আগে এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা, যা ছিল ব্যাংক খাতের বিতরণ করা মোট ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। এই হার সেপ্টেম্বর শেষে কমে হয়েছে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। অর্থাৎ নির্বাচন সামনে রেখে খেলাপি ঋণের পরিমাণে বড় কোনো পরিবর্তন হয়নি।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার সময় খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। এখন তা দেড় লাখ কোটি টাকার ওপরে। ১৪ বছরে খেলাপি ঋণ সাত গুণ বেড়েছে।
নীতিমালায় যেসব ছাড়
নতুন নীতিমালার ফলে খেলাপি ঋণ নিয়মিত হলে তা পাঁচ থেকে আট বছরে পরিশোধের সুযোগ পাওয়া যায়। আগে এসব ঋণ শোধে সর্বোচ্চ দুই বছর সময় দেওয়া হতো। এখন নতুন করে ঋণও পাওয়া যাচ্ছে।
আগে যেকোনো পরিমাণ মেয়াদি খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ এককালীন অর্থ জমা দিতে হতো। এখন আড়াই থেকে সাড়ে ৬ শতাংশ জমা দিলেই হচ্ছে। আগে চলমান ও তলবি খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে ৫ থেকে ১৫ শতাংশ এককালীন অর্থ জমা দিতে হতো, এখন আড়াই থেকে সাড়ে ৫ শতাংশ অর্থ জমা দিলেই চলছে।
আগের নিয়মে খেলাপি মেয়াদি ঋণ নিয়মিত হলে তা পরিশোধে ৯ থেকে ২৪ মাস সময় দেওয়া হতো। নতুন নীতিমালায় ১০০ কোটি টাকার কম ঋণে ৬ বছর, ৫০০ কোটি টাকার কম ঋণে ৭ বছর ও ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ পরিশোধে ৮ বছর পর্যন্ত সময় দেওয়া হচ্ছে।
আগে চলমান ও তলবি ঋণ নিয়মিত হলে তা পরিশোধে ৬ থেকে ১৮ মাস সময় দেওয়া হতো। এখন ৫০ কোটি টাকার কম ঋণ পরিশোধে ৫ বছর, ৩০০ কোটি টাকার কম ঋণ শোধে ৬ বছর ও ৩০০ কোটি টাকার বেশি ঋণে ৭ বছর পর্যন্ত সময় দেয়।
বিশেষ সুবিধা নিয়ে যেসব খেলাপি গ্রাহক ঋণ নিয়মিত করেছেন, তাঁরা ব্যাংক থেকে আবারও ঋণ নিতে পারছেন। এ জন্য সাধারণ গ্রাহকদের বকেয়া ঋণের ৩ শতাংশ ও রপ্তানিকারকদের ২ শতাংশ অর্থ জমা দিতে হচ্ছে। আগে নতুন ঋণ নিতে সাধারণ গ্রাহকদের ১৫ শতাংশ ও রপ্তানিকারকদের সাড়ে ৭ শতাংশ অর্থ জমা দিতে হতো।
যেসব মেয়াদি ঋণ নিয়মিত রয়েছে, তা–ও নতুন করে পুনর্গঠন করা যাচ্ছে। এতে বিদ্যমান মেয়াদের অবশিষ্টের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত সময় বাড়ানো যাচ্ছে। আগে যা ছিল ২৫ শতাংশ।