নকল-ভেজাল ওষুধে বিপন্ন জীবন ওষুধনীতিতে প্রচারণা আটকে রাখায় জনসচেতনতার উদ্যোগ নেই প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের কাছেই জিম্মি ওষুধ বাণিজ্য

সাঈদুর রহমান রিমন
বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি ওষুধের সুনাম থাকলেও দেশজুড়ে ওষুধ বাণিজ্যে সীমাহীন নৈরাজ্য চলছে। নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধের ছড়াছড়িতে মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। দেশের সর্বত্রই নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। সারা দেশে ওষুধ বাণিজ্যের এই অরাজক পরিস্থিতির জন্য কয়েকটি সংঘবদ্ধ চক্র মুখ্য ভূমিকা রাখছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কঠোর মনিটরিং ও কার্যকর শাস্তির ব্যবস্থা না থাকায় ভেজালকারীরা বেপরোয়া। যেসব কোম্পানি নকল ও ভেজাল ওষুধ তৈরির দায়ে অভিযুক্ত, সেগুলোই ঘুরে-ফিরে বার বার এ তৎপরতায় লিপ্ত থাকছে। ভেজাল ও নকল ওষুধের কারণে অনেক সময় রোগী সুস্থ হওয়ার বদলে হয়ে পড়ছে আরও অসুস্থ। প্রাণহানির ঘটনাও কম নয়। কিন্তু ওইসব ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিরা পার পেয়ে যাচ্ছেন আইনের ফাঁকে। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হোতারা থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। নকল ওষুধ প্রস্তুত ও ভেজাল ওষুধ বিপণনে রাজধানীর মিটফোর্ডকেন্দ্রিক ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট, ফার্মেসিগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির কোনো কোনো নেতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। সরকারের মাঠ পর্যায়ে থাকা ড্রাগ সুপারদের যোগসাজশে দেশজুড়ে সংঘবদ্ধভাবে গড়ে উঠেছে নকল-ভেজাল ওষুধের বিশাল নেটওয়ার্ক। ওষুধ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে এই অপরাধীদের তৎপরতা কমে আসবে। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতায় কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না ভেজাল, মানহীন ও নকল ওষুধ। শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল সবখানেই ভেজাল ওষুধের বাধাহীন দৌরাত্ম্য। জীবন বাঁচানোর ওষুধ কখনো কখনো হয়ে উঠছে প্রাণঘাতী। ওষুধ সম্পর্কিত জনসচেতনতামূলক প্রচারে নানা বাধাবিপত্তি থাকায় ক্রেতারা জানতেও পারছেন না তারা টাকা দিয়ে কী ওষুধ কিনছেন। ওষুধ বাণিজ্যের নৈরাজ্য রোধে ক্রেতাদের রক্ষায় কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। কয়েক হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ, বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান এবং বিদেশে রপ্তানিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা ওষুধ শিল্প নিজ দেশেই জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। নকল ও ভেজাল ওষুধ প্রস্তুত এবং বাজারজাত প্রতিরোধেও নেওয়া হয় না সমন্বিত কোনো পদক্ষেপ। ওষুধের উপাদান ও কার্যকারিতার ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা পর্যন্ত থাকে না। কমিশন-প্রলুব্ধ অনেক ডাক্তার সেসব ওষুধ আর টেস্ট লিখে দিচ্ছেন রোগীকে। এতে অতিরিক্ত টাকা খরচ করেও পর্যাপ্ত সুফল পাচ্ছেন না রোগী। এসব নিয়মনীতির ফাঁক গলে বাজারে ঢুকে পড়ছে নিম্নমানের ও ভেজাল ওষুধ। রাজধানীর মিটফোর্ডের ওষুধ মার্কেটের কয়েকটি চক্রের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে মানহীন নকল-ভেজাল ওষুধ। ওষুধের পাইকার ব্যবসায়ীদের সূত্র জানিয়েছেন, মিটফোর্ডের মা ভবনকে তারা ভেজাল ওষুধের সূতিকাগার হিসেবেই চেনেন, জানেন। সেখানকার একটি সিন্ডিকেট দেশের অন্তত ৪০টি জেলার ওষুধ বাজারের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ করছে বলেও সূত্রটির দাবি। একইভাবে শাহবাগ, এলিফ্যান্ট রোড, ফার্মগেট, গুলশান, মহাখালীতে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট নিজস্ব স্টাইলে পৃথকভাবে ওষুধ বাজার নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে।

ধানমন্ডি, গুলশান, উত্তরা, পান্থপথের কয়েকজন ওষুধ ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট কেবল বিদেশি ওষুধ বাজারজাতের অপ্রতিরোধ্য বাণিজ্য ফেঁদে বসেছে। তারা প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে বৈধ-অবৈধ উপায়ে বিভিন্ন দেশের নিম্নমানের ওষুধ এনেও উচ্চমূল্যের বাজার দখলে রাখছে। অন্যদিকে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ওষুধের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে নকল-ভেজাল ওষুধ তৈরির প্রভাবশালী একটি চক্রও গড়ে উঠেছে দেশে। হারবাল ও ইউনানিকেন্দ্রিক অর্ধশতাধিক ভুঁইফোঁড় প্রতিষ্ঠানের সংঘবদ্ধ চক্র যেনতেনভাবে তৈরি করা ওষুধ গ্রামগঞ্জে একচেটিয়া বাজারজাত করছে। অর্ধশিক্ষিত অসচেতন মানুষজনকে টার্গেট করেই প্রতিষ্ঠানগুলো সেক্স মেডিসিন আর ভিটামিন ওষুধের ভয়ঙ্কর বাণিজ্য ফেঁদে বসেছে। তাদের কথিত যৌনশক্তিবর্ধক উচ্চক্ষমতার নানা ট্যাবলেট-সিরাপের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় গড়ে প্রতি বছর তিন শতাধিক ব্যক্তির জীবনহানি ঘটছে। অগণিত মানুষ চিরতরে যৌনক্ষমতা হারানোসহ জটিল-কঠিন রোগে আক্রান্ত হওয়ার নানা তথ্য রয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরে। এত কিছুর পরও প্রভাবশালী চক্রটির বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালানোর সাহস করে না কেউ।

শাস্তিহীনতায় নকল-ভেজাল : নকল ও ভেজাল ওষুধ বাজারজাত ও প্রস্তুতের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান কার্যকর না হওয়ায় প্রাণঘাতী এ দৌরাত্ম্য থামানো যাচ্ছে না। বাংলাদেশে ১৯৮০ থেকে ’৯২ সাল পর্যন্ত ক্ষতিকর প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে কয়েক হাজার শিশুর মৃত্যু ঘটেছিল। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর প্যারাসিটামল-সংশ্লিষ্টতায় ২ হাজার শিশু মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করে জানায়, ভয়াবহ ওই ঘটনায় অধিদফতরের পক্ষ থেকে পাঁচটি মামলা করা হয়েছে। ভেজাল ওষুধকেন্দ্রিক ভয়াবহতায় শিশু হত্যাযজ্ঞের মামলাগুলো চলছে ২৬ বছর ধরে। অতিসম্প্রতি একটি মামলায় আদালত দোষী ব্যক্তিদের এক বছর করে কারাদ াদেশ দিয়েছে। বাকি চারটি মামলা এখনো নিষ্পত্তিহীন। বিচারের এ দীর্ঘসূত্রতা ও শাস্তির এমন বিধানে নকল ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাতকারী চক্রগুলো আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। দেশে চার ক্যাটাগরিতে ৫৫১টি প্রতিষ্ঠান নানারকম ওষুধ প্রস্তুত করে। এর মধ্যে ২৬৮টি ইউনানি, ২০১টি আয়ুর্বেদী ও হারবাল এবং ৮২টি হোমিও ক্যাটাগরির ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আয়ুর্বেদী ও হারবালের নামে অলিগলি, গোপন কুঠুরিতে চুপিসারে গজিয়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলো সারা বছর শুধু ‘যৌনশক্তিবর্ধক’ ওষুধ প্রস্তুত ও বাজারজাতের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। এসব ওষুধের কারণেই গত কয়েক বছরে দেশে ধর্ষণ, গণধর্ষণের ঘটনা অতিমাত্রায় বেড়েছে বলেও মনে করছেন অনেকে। ভুক্তভোগী মানুষজন ও বাজার পণ্য পর্যবেক্ষণকারী একাধিক সংস্থা বাজারে থাকা যৌনশক্তিবর্ধক ভিটামিন-জাতীয় ওষুধগুলো পুনঃ পরীক্ষাপূর্বক এগুলোর উৎপাদন-বাজারজাত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তীব্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় জীবনহানিকর উচ্চমাত্রার যৌনশক্তিবর্ধক ওষুধের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নিতে অধিদফতর বরাবরই নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
দায় চাপিয়েই খালাস : দেশের বৈধ ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মনীতি অনুযায়ী ঢাকা টেস্টিং ল্যাবরেটরি (ডিটিএল) থেকে ওষুধের মান পরীক্ষা করাসহ অন্যান্য উপাদানের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু নমুনা ওষুধে এসব নিয়মনীতি হুবহু পালন করা হলেও বাজারে দেওয়া ওষুধে তার কোনো মিল নেই। অনুমোদিত সার্টিফিকেট অনুসারে ওষুধ প্রস্তুত হচ্ছে কিনা সে বিষয়টি তদারকি করারও কেউ নেই। অধিদফতর সূত্র বরাবরই এ ক্ষেত্রে নিজেদের জনবল সংকটের কথা বলে দায়িত্ব এড়িয়ে থাকেন। মাঠ পর্যায়ে থাকা ড্রাগ সুপারদের সঙ্গে ভেজাল ওষুধ কোম্পানিগুলোর থাকে সুসম্পর্ক। মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে তাদের নকল-ভেজাল ওষুধ নির্বিঘ্নে বাজারজাত হওয়ার ক্ষেত্রেও ড্রাগ সুপাররা বিশেষ ভূমিকা রাখেন বলে অভিযোগ রয়েছে। একটি বেসরকারি ওষুধ প্রতিষ্ঠানের কোয়ালিটি কন্ট্রোলার জবেদুল আলম বলেন, ‘ওষুধ বিক্রি করেন বলেই নকল ওষুধ চিহ্নিত করার ক্ষমতা, অভিজ্ঞতা ফার্মেসি মালিকদের থাকার কথা নয়। কারণ সেটি মালিকদের সমিতি কিংবা বিশেষজ্ঞদের কাজ নয়। আবার কোনো ওষুধ নকল বা ভেজাল কিনা তা রোগী তো নয়ই, অনেক সময় চিকিৎসকের পক্ষেও বোঝা সম্ভব নয়। ভেজাল বন্ধে সচেতন না হলে সাধারণ মানুষ হয়তো আবারও আমদানি করা ওষুধের ওপর নির্ভর করতে শুরু করবেন।’ ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক খন্দকার সগীর আহমেদ বলেন, ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার বাংলাদেশের ওষুধ ব্যবস্থাপনা ও স্বাস্থ্যসেবা আমূল বদলে দিয়েছে। আমরা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি আধুনিক। আমাদের ল্যাবরেটরিগুলোও এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হওয়ার স্বীকৃতি পেয়েছে।’ তিনি আরও জানান, ‘মহাপরিচালকের একান্ত প্রচেষ্টায় দেশে প্রতিষ্ঠিত মডেল ফার্মেসিগুলো যাবতীয় নকল-ভেজাল ওষুধের দৌরাত্ম্য থেকে ভুক্তভোগীদের রেহাই দিতে কাজ করছে।’ এ ব্যবস্থাপনা সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়াটা এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি বলেও মন্তব্য করেন পরিচালক। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সহকারী পরিচালক বলেন, ‘নকল-ভেজাল ওষুধ প্রতিরোধে মিটফোর্ড থেকে শুরু করে সারা দেশে নিয়মিত আমাদের অভিযান চলে। নিম্নমানের ওষুধ বন্ধে সারা দেশে আমাদের কমিটি কাজ করছে। আমরা এক জায়গায় বার বার অভিযান চালাই। আমি বিশ্বাস করি, কার্যকর তদারকির মাধ্যমে নকল-ভেজাল ওষুধ বিপণন বন্ধ হয়ে যাবে।’ ওষুধ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে মোট উৎপাদিত ওষুধের অন্তত ২ শতাংশ অর্থাৎ প্রতি বছর ৪ শতাধিক কোটি টাকা মূল্যের ভেজাল, নকল ও নিম্নমানের ওষুধ তৈরি হয়। অন্যদিকে ওষুধ কোম্পানির মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির কর্মকর্তারা বলছেন, যারা ভেজাল ওষুধ বানায়, তাদের অধিকাংশই সমিতির সদস্য নয়।

জাতীয় শীর্ষ সংবাদ