বিশেষ প্রতিবেদক
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আর ২৪ দিন। নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা শুরু হবে ১৮ ডিসেম্বর থেকে। কিন্তু এখনো আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টির আসন ভাগাভাগির কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আবার জাতীয় পার্টির সঙ্গে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত না হওয়ায় আ.লীগের সঙ্গে ১৪ দলের শরিকদের আসন ভাগাভাগিও ঝুলে আছে। এমন পরিস্থিতিতে আধিপত্যের দ্বন্দ্বে আলাদা হয়ে পড়া রওশন এরশাদ অনুসারীদের নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জাতীয় পার্টিতে মনোনয়ন নিয়ে অনিয়মের নালিশ করেছেন। রওশন প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন, জাতীয় পার্টির সঙ্গে আসন সমঝোতার আগে তাদের যেন তা জানানো হয়। খণ্ডিত জাতীয় পার্টি ও জি এম কাদেরের সঙ্গে নির্বাচনী জোট না করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন রওশন। তিনি অভিযোগ করেছেন, জি এম কাদের অবৈধভাবে জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব দখল করেছেন।
জাতীয় পার্টিতে রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরের বিরোধ দীর্ঘদিনের। আসন্ন নির্বাচনে দলের মনোনয়নপত্র নেননি রওশন ও তার ছেলে সাদ এরশাদ। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর কাছে তার নালিশ আসন ভাগাভাগির পথে বাধা বা গতিরোধ করল বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
তবে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে নীরবতা পালন করছেন। অনেকে বলেছেন, তিনি কৌশলী ঘুমে আছেন।
গতকাল রওশন বলেছেন, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেননি। আমার ছেলের জায়গায় উনি ইলেকশন করছেন। ওর কথা তার মনে নেই। জাতীয় পার্টির নেতাদের প্রতি সমর্থন আছে কিনা জানতে চাইলে রওশন বলেন, আমাদের ইচ্ছা করে বাদ দিয়েছে। কেন সমর্থন থাকবে।
কাজী মামুনুর রশিদ রওশনের লিখিত বক্তব্যের কথাটি জানান। এই বক্তব্যে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীকে তিনি (রওশন) বলেছেন জি এম কাদের অবৈধভাবে জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব দখল করেছেন। সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে সুকৌশলে তাকে, সাদ এরশাদকে ও গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সরিয়ে দিয়েছেন। দলের মধ্যে ক্যু করে নেতৃত্ব গ্রহণ করেছেন। রওশন বলেন, নির্বাচন অধিক গ্রহণযোগ্য করার জন্য জাতীয় পার্টি যাতে এককভাবে সারা দেশে প্রতিযোগিতামূলকভাবে নির্বাচন করে, সেটি নিশ্চিত করার অনুরোধ করেছেন তিনি।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে জাতীয় পার্টির দোটানার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন রওশন। ওই নির্বাচনের পর থেকে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হন রওশন। এখনো সংসদেও তিনি বিরোধীদলীয় নেতা। ২০১৯ সালে জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যু হয়। তারপর দলের নেতৃত্ব নিয়ে টানাপড়েন শুরু হয়।
জানা গেছে, রওশন তার নিজের পাশাপাশি সাবেক মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গার জন্য রংপুর-১, ছেলে রাহগির আলমাহি সাদ এরশাদের জন্য রংপুর-৩, ময়মনসিংহ জাতীয় পার্টির সাবেক সভাপতি কে আর ইসলামের জন্য ময়মনসিংহ-৬, রুস্তম আলী ফরাজীর জন্য পিরোজপুর-৩সহ কয়েকটি আসন চেয়েছিলেন। মশিউর রহমান রাঙ্গাকে জাতীয় পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারে রাজি হননি জি এম কাদের। তার আসনে প্রার্থী করা হয়েছে জি এম কাদেরের ভাতিজা আসিফ শাহরিয়ারকে। জি এম কাদের প্রার্থী হয়েছেন রংপুর-৩ আসনে। চারবারের সংসদ সদস্য রুস্তম ফরাজীকেও মনোনয়ন দেওয়া হয়নি।
দ্বন্দ্ব প্রকটতর হলে গত ২৯ ডিসেম্বর রওশন এরশাদ ভোটে প্রার্থী না হওয়ার ঘোষণা দেন। রওশন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিব সহযোগিতা না করার অভিযোগ তুলেছিলেন, দলের পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। রওশন অনুসারীরা বলছেন, জাতীয় পার্টির প্রায় ৩০০ নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। রওশনপন্থিদের শুধু রুহুল আমিন হাওলাদারকে পটুয়াখালী-১ আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়। সাদ এরশাদ রংপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য। ওই আসনে আসন্ন নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন জি এম কাদের। জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন না পেয়ে রংপুর-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন মশিউর রহমান রাঙ্গা।
আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যে আগামী নির্বাচনের আসন ভাগাভাগি নিয়ে মোটা দাগে দুই দফা বৈঠক হয়েছে। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। জাতীয় পার্টি আগামী নির্বাচন থেকে সরে যেতে পারে বলে সন্দেহ আওয়ামী লীগের। গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর এ সন্দেহ প্রকাশ করেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থিত একাধিক মন্ত্রী জানান, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন জাতীয় পার্টিকে বিশ্বাস করা যায় না। প্রধানমন্ত্রী তখন বলেন, জাতীয় পার্টি আগামী নির্বাচনে কী করবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। শেখ হাসিনা আরো বলেন, জাতীয় পার্টি রওশন এরশাদ, তার ছেলে রাহগির আল মাহি এরশাদ (শাদ এরশাদ) ও মসিউর রহমানকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে রেখেছে। তারা কখন কী করবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
জাতীয় পার্টি থেকে ভোট করতে আগ্রহীদের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের কাছে কমপক্ষে ৩৫টি আসন চাওয়া হচ্ছে। তবে ১৪ নভেম্বর দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভায় সবাই নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে মতামত দিয়েছেন।
এদিকে, জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জি এম) কাদের গত ১৪ নভেম্বর দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভায় বক্তব্য দেন। ওইদিন রাতে তিনি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেন। গত ২০ নভেম্বর মনোনয়নপত্র বিক্রি শুরু করে জাতীয় পার্টি। ঢাকা-১৭ ও রংপুর-৩ আসনে প্রার্থী হয়েছেন জি এম কাদের। তিনি মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করে জমাও দিয়েছেন প্রতিনিধির মাধ্যমে।
জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ গত রাতে প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, জাতীয় পার্টির রওশন অনুসারীরা নির্বাচনে আসছে না। জি এম কাদের অনুসারীরা নীরবতা পালন করছে। আগামী ১৭ ডিসেম্বর তারা মনোনয়ন প্রত্যাহার করতেও পারে। কারণ সরকার মনে করছে, জাতীয় পার্টি কখন কী করবে তার ঠিক নেই। জাতীয় পার্টি ও আরো কিছু দলের প্রার্থীরা মনোনয়ন প্রত্যাহার করলে নির্বাচন বিলম্বিত বা অনিশ্চয়তায় পড়তে পারে বা কোনো সংকট তৈরি হতে পারে।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু গত রাতে বলেন, আমাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে কী আলাপ করেছেন সেটা তিনি জানেন। এর সঙ্গে আমরা কোনোভাবে সম্পৃক্ত না। রওশন এরশাদের সঙ্গে মসিউর রহমান রাঙ্গাসহ দুজন গেছেন। তারা দল থেকে বহিষ্কৃত। জাতীয় পার্টি ভাগাভাগি ছাড়াও নির্বাচনে অংশ নিতে সক্ষম। রওশন এরশাদের তোলা জাপায় দখলবাজির বিষয়ে তিনি গতকাল সাংবাদিকদের বলেছেন, সবাই জানে ২০১৯ সালে জাতীয় পার্টির কাউন্সিল হয়। সেই কাউন্সিলের মাধ্যমে গোলাম মোহাম্মদ কাদের পার্টির চেয়ারম্যান হন। সেখানে ক্যু করার সুযোগ কোথায়। কাউকে যদি তার পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে আসা হয়, তবে সেটাকে ক্যু বলা হয়।