নিজস্ব প্রতিবেদক
সপ্তাহ ব্যবধানে আবারও অস্থির হয়ে ওঠেছে নিত্যপণ্যের বাজার। শীতের সবজিতে ভরপুর বাজার, তারপরও কমছে না দাম। কিছুদিন স্থিতিশীল থাকার পর আবারও বেড়েছে মুরগির ডিমের দাম। বাড়তি দামে এসব পণ্য কিনতে ক্রেতাদের নাভিশ্বাস চরমে। এ অবস্থায় অনেকেই পণ্য না কিনেই ফিরে যাচ্ছেন। তাদের মতে, বাজারের উর্ধ্বমুখী দামে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
শুক্রবার (২২ ডিসেম্বর) রাজধানীর পুরান ঢাকা, কারওয়ান বাজার ও মোহাম্মদপুরের একাধিক পাইকারি ও খুচরা বাজার ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
টানা চতুর্থবার বেস্ট ব্র্যান্ড অ্যাওয়ার্ড স্বীকৃতি পেল বসুন্ধরা এলপি গ্যাস
সরেজমিনে খুচরা ও পাইকারি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত সপ্তাহের তুলনায় অধিকাংশ সবজির দাম বেড়েছে কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা। গত সপ্তাহে শীতসবজি শিম, ফুলকপি, বাঁধাকপি, শালগম, মুলা ৪০ থেকে ৫০ টাকার মধ্যে বিক্রি হলেও এখন সে তুলনায় ১০ টাকা বেশি দামে কিনতে হচ্ছে।
এছাড়া গোল বেগুন বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। বেশি চড়েছে লাউয়ের দাম, প্রতিটি কিনতে খরচ করতে হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা, যা গত সপ্তাহে কেনা গেছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়।
গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে ২০ টাকার মতো বেড়ে কাঁচা মরিচ বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৬০ টাকায়। বাজারে লালশাকের আঁটি ১৫ টাকা, পুঁইশাক ৩০ টাকা, কলমি শাক ১০ টাকা, পালংশাক ১০ টাকা ও লাউ শাক ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এ ছাড়া পাইকারি পর্যায়ে কিছুটা কমলেও খুচরা পর্যায়ে বেড়ে গেছে কাঁচা মরিচের দাম। বাজারে খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকায়; আর পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৮০ টাকায়।
বাজার করতে আসার এক ক্রেতা হাফসা বলেন, সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বাজারে এসে বিপাকে পড়তে হচ্ছে। সাধ্যের চেয়ে অতিরিক্ত দামে বিক্রি হচ্ছে সবজি। যা সংসার খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
সবজীর এমন উর্ধ্বমুখী দামের কারণ হিসেবে বাজারে সরবরাহ কমে যাওয়াকে দায়ী করছেন বিক্রেতারা। তারা বলেন, শীতকাল হলেও মূলত হরতাল-অবরোধের কারণে বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণে শাক-সবজি আসতে পারছে না। এতে বাড়ছে দাম।
এদিকে প্রতিদিন লাফিয়ে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম। দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ বাড়লেও গত সপ্তাহের চেয়ে কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে কেজি বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকা। আর ভারতীয় পেঁয়াজ ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা। আর দেশি পুরনো পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকার বেশি।
বিক্রেতাদের দাবী, তীব্র শীতের কারণে ক্ষেত থেকে পেঁয়াজ তুলতে পারছে না কৃষক, আর অন্যদিকে ভারত থেকে পেঁয়াজের আমদানী বন্ধ রয়েছে। ফলে এমন পরিস্থিতিতে বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ কম।
সপ্তাহ ব্যবধানে খুচরা পর্যায়ে কেজিপ্রতি ২০ টাকা বেড়ে দেশি রসুন ২৮০ টাকায় ও আমদানি করা রসুন ২৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহে দেশি রসুন ২৬০ টাকা ও আমদানি করা রসুন বিক্রি হয়েছিল ২২০ টাকায়। আড়ত পর্যায়ে প্রতি কেজি দেশি রসুন বিক্রি হচ্ছে ১৯০ থেকে ২১০ টাকায়। আর আমদানি করা রসুন বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ১৯০ টাকায়।
কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা বেড়ে মানভেদে প্রতি কেজি আদা বিক্রি হচ্ছে ২১০ থেকে ২২০ টাকায়। বিক্রেতারা বলছেন, আমদানিতে ঘাটতি না হলে আদার দাম শিগগিরই কমে আসবে।
তবে কিছুটা স্থিতিশীল রয়েছে চালের বাজার। প্রতিকেজি নতুন আটাইশ ৪৭ থেকে ৪৯ টাকা, পুরান আটাইশ ৫২ থেকে ৫৪ টাকা, নাজিরশাইল ৭৬ থেকে ৮৪ টাকা ও মিনিকেট চাল ৬৫ থেকে ৬৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
আর আমদানি শুল্ক অর্ধেক কমানোর পরও বাজারে বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে চিনি। প্রতি কেজি খোলা বিক্রি হচ্ছে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকায়। আর বাজার থেকে উধাও প্যাকেটজাত চিনি। বিক্রেতাদের দাবি, বাজারে চিনি পাওয়াই যাচ্ছে না। শুল্ক কমিয়ে লাভ নেই। পাইকারি পর্যায়ে দাম না কমলে খুচরা পর্যায়েও দাম কমবে না।
অন্যদিকে সবজী, পেঁয়াজ, আদা, রসুনের মতো দাম বেড়েছে মাছ-মাংসের বাজারেও। ১৭০-১৭৫ টাকা কেজির ব্রয়লার মুরগি ২০০ টাকায় ঠেকেছে। একইভাবে বেড়েছে সোনালি মুরগির দাম। আগে এ জাতের মুরগির কেজি ছিল ২৮০ থেকে ২৯০ টাকায়। দাম বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩২০ টাকায়। গত সপ্তাহে ফার্মের মুরগির ডিমের দাম ছিল ১৩০ টাকার ডজন। এ সপ্তাহে বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকায়।
এদিকে, রাজধানীতে প্রতি কেজি গরুর মাংসের কেজি ৬৫০ টাকা নির্ধারণ করা হলেও কোথাও কোথাও ৭০০ টাকা দরে বিক্রি করতে দেখা গেছে।
সপ্তাহ ব্যবধানে বাজারে আবারও বেড়েছে ডিমের দাম। ডজন প্রতি ৫ টাকা বেড়ে প্রতি ডজন লাল ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকায়। এছাড়া প্রতি ডজন সাদা ডিম বিক্রি হচ্ছে ১২৫ টাকায়। আর প্রতি ডজন হাঁসের ডিম ২১০ টাকা ও দেশি মুরগির ডিম ২৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ক্রেতার ঘাম ছুটাচ্ছে মাছের দামেও। সপ্তাহ ব্যবধানে মাছের দাম কেজিতে সামান্য বাড়লেও তা সাধ্যের বাইরে বলছেন ক্রেতারা। বিক্রেতাদের দাবি, মাছের বেচা-বিক্রি কমে যাওয়ায় দাম কিছুটা বেড়েছে। তবে ইলিশ ছাড়া অন্যান্য মাছের সরবরাহ পর্যাপ্ত রয়েছে।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি বোয়াল ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা, আইড় ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা, বাইম ১ হাজার টাকা, দেশি কৈ ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা, শিং ১ হাজার ৪০০ টাকা, শোল ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা ও নদীর পাঙাশ বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায়। আকারভেদে প্রতি কেজি রুই ৩৮০ থেকে ৪৫০ টাকা, কাতলা ৪০০ থেকে ৪৮০ টাকা, চাষের শিং ৫৫০ টাকা, চাষের মাগুর ৫২০ টাকা, চাষের কৈ ২২০ থেকে ২৫০ টাকা, কোরাল ৭৫০ টাকা, টেংরা ৬৫০ টাকা, চাষের পাঙাশ ২০০ থেকে ২২০ টাকা ও তেলাপিয়া ২০০ থেকে ২৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
তবে দেখা নেই রুপালি ইলিশের। দুই-একজন বিক্রেতার কাছে মিললেও কিনতে হচ্ছে চড়া দামে। ১ কেজি ওজনের ইলিশের দাম হাঁকা হচ্ছে ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত। আর ৬০০-৭০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ১ হাজার ৪০০ টাকা ও ৪০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকায়।
নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজারের দামের এমন ঊর্ধ্বগতিতে নাজেহাল ক্রেতারা। তারা সংসার সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। তাদের ভাষ্য, প্রতি বছর শীতকালে হরেক রকম সবজির সরবরাহ বাড়ায় দাম কমে। তবে এবার ঠিক উল্টো। প্রতি সপ্তাহেই বাড়ছে দাম। এতে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
বাজার করতে আসা চাকরিজীবী ইলিয়াস হোসেন বলেন, বাজারে সবকিছুর দাম বেড়েছে। কোনো পণ্যের দামই ক্রেতাদের নাগালের মধ্যে নেই। বাজারের ঊর্ধ্বমুখী দামে টোনাটুনির মতো আমার সংসার চালাতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ২১ ডিসেম্বরের হালনাগাদকৃত তথ্য বলছে, এক বছরের ব্যবধানে প্রতিকেজিতে দেশি ও আমদানি করা রসুনের দাম বেড়েছে যথাক্রমে ২০৬.৬৭ শতাংশ ও ৮৬.৩৬ শতাংশ। আর দেশি ও আমদানি করা পেঁয়াজের দাম বেড়েছে যথাক্রমে ১৫৮.৮২ শতাংশ ও ২০৫.৮৮ শতাংশ।
নিত্যপণ্যের এ অস্থির বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত বাজার মনিটরিংয়ের দাবি জানিয়েছেন ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই। ক্রেতারা বলছেন, নিয়মিত বাজার মনিটরিং করা হয় না। এতে বিক্রেতারা ইচ্ছেমতো দাম বাড়ানোর সুযোগ পায়।
আর বিক্রেতারা বলেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ইচ্ছে মতো দাম বাড়াচ্ছে। বাজারে নিয়মিত অভিযান চালালে অসাধুদের দৌরাত্ম্য কমবে।