আন্তর্জাতিক ডেস্ক
ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি আক্রমণ থামাতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ওপর চাপ দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। বেসামরিক লোকজনকে নিরাপদ রাখার একটি গ্রহণযোগ্য এবং কার্যকরী পরিকল্পনা ছাড়া ইসরায়েলের উচিত হবে না গাজার রাফায় অভিযান চালানো। রোববার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে এ কথা বলেছেন বলে জানিয়েছে হোয়াইট হাউস।
বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, রাফায় সম্ভাব্য ইসরায়েলি অভিযান নিয়ে এখন পর্যন্ত এটিই ছিল প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সবচেয়ে বেশি শক্ত বক্তব্য। বাইডেন গত সপ্তাহে গাজায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযানকে ‘মাত্রাতিরিক্ত’ বলে বর্ণনা করেন। নেতানিয়াহুর সঙ্গে টেলিফোন আলাপে বাইডেন মানবিক ত্রাণ সরবরাহ জোরদার করার জন্য ‘জরুরি এবং সুনির্দিষ্ট’ পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান। ইসরায়েলের টেলিভিশন চ্যানেল ১৩ জানায়, বাইডেন এবং নেতানিয়াহুর মধ্যে ফোনালাপ ৪৫ মিনিট ধরে চলে।
যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেছেন, ‘টেলিফোন আলোচনায় যুদ্ধ বিরতির সম্ভাবনা নিয়ে আলাপেই বেশি সময় নিয়েছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা কূটনৈতিক তৎপরতার পর যুদ্ধে বিরতির বিনিময়ে হামাসের হাতে বন্দি বাকি জিম্মিদের মুক্তির জন্য একটি চুক্তি করার কাঠামো এখন প্রায় দাঁড় করানো হয়েছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তা বিস্তারিত কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি। নেতানিয়াহুর অফিস এই টেলিফোন আলাপ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
হামাসের আল আকসা টেলিভিশন কেন্দ্র অজ্ঞাত এক হামাস কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে বলেছে, রাফায় সেনা অভিযান চালানো হলে গাজায় যুদ্ধবিরতি এবং ইসরায়েলি জিম্মি মুক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, মিসর এবং কাতারের মধ্যস্থতায় চলমান আলোচনা ভেস্তে যাবে।
শান্তি চুক্তি নিয়ে মিসরের হুমকি
এর আগে মিসর হুমকি দেয়, ইসরায়েলের সেনাবাহিনী যদি গাজার সীমান্ত শহর রাফায় অভিযান চালায়, তাহলে তারা ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের শান্তি চুক্তি থেকে বের হয়ে আসবে। রোববার এ কথা বলেছেন দুজন মিসরীয় কর্মকর্তা এবং একজন পশ্চিমা কূটনীতিক। মিসর আশঙ্কা করছে, রাফায় যুদ্ধ শুরু হলে অবরুদ্ধ গাজায় ত্রাণ সরবরাহের প্রধান পথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
এই হুমকির আগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, হামাসের বিরুদ্ধে গত চার মাস ধরে চলা যুদ্ধে জিততে হলে রাফায় সেনাবাহিনী পাঠাতে হবে। তিনি বলেন, রাফায় এখনো হামাসের চারটি ব্যাটেলিয়ন আছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে মিসর এবং ইসরায়েলের মধ্যকার ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি বাতিলের হুমকি দেওয়া হয়। এই চুক্তি প্রায় ৫০ বছর ধরে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়তা করেছে।
গাজার ২৩ লাখ মানুষের অর্ধেকের বেশি রাফায় আশ্রয় নিয়েছে। তারা ভূখণ্ডের অন্যান্য এলাকার যুদ্ধ থেকে পালিয়ে এসে সীমান্তের কাছে তাঁবু আর জাতিসংঘ পরিচালিত আশ্রয় শিবিরে ঠাসাঠাসি করে থাকছে। মিসরের আশঙ্কা, লাখ লাখ ফিলিস্তিনি শরণার্থীর ঢল নামতে পারে যাদের আর গাজায় ফেরত যেতে দেওয়া হবে না।
নেতানিয়াহু ফক্স নিউজকে বলেন, রাফার উত্তরে যাবার মতো প্রচুর জায়গা আছে এবং ইসরায়েল সরে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের জায়গামতো চলে যাবার জন্য লিফলেট, সেল ফোন, নিরাপদ করিডর এবং অন্যান্য জিনিস দেবে।
ত্রাণ সংস্থাগুলো বলেছে, রাফায় সেনা অভিযান চললে গাজার বাসিন্দাদের অবস্থা আরও খারাপ হবে, যেখানে ৮০ শতাংশ মানুষ বাস্তুচ্যুত এবং জাতিসংঘের মতে, জনগোষ্ঠীর ২৫ শতাংশ অনাহারের সম্মুখীন। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের দুই ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েল এবং মিসরের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে।
গাজার মানুষ কোথায় যাবে?
কাতার, সৌদি আরব এবং অন্যান্য দেশ হুঁশিয়ারি দিয়েছে, ইসরায়েল রাফায় সেনা অভিযান চালালে তার গুরুতর পরিণতি হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি প্রধান জোসেফ বোরেল বলেন, রাফায় ইসরায়েলি অভিযান অবর্ণনীয় মানবিক দুর্ভোগ এবং মিসরের সঙ্গে ভয়ানক উত্তেজনা তৈরি করবে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক বিবৃতিতে বলেছে, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করা একটি যুদ্ধাপরাধ এবং যেসব বেসামরিক বাসিন্দা সরে যাবে না, তারা আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের আওতায় সুরক্ষার দাবিদার। হোয়াইট হাউস যদিও ইসরায়েলে দ্রুত অস্ত্র পাঠিয়েছে এবং যুদ্ধবিরতির আন্তর্জাতিক দাবির মুখে ইসরায়েলকে সমর্থন দিচ্ছে। তবে এখন তারা বলছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে রাফায় স্থল অভিযান বেসামরিক মানুষের জন্য ভয়াবহ হবে।
ইসরায়েল এবং মিসর ৭০-এর দশকে তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের মধ্যস্থতায় ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি করার আগে পাঁচবার যুদ্ধ করেছে। মিসর গাজার সঙ্গে তাদের সীমান্ত শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে, পাঁচ কিলোমিটার রাফার জোন তৈরি করেছে, মাটির ওপরে এবং নিচে কংক্রিটের দেয়াল তুলেছে। হামাস ওই সীমান্তে সুড়ঙ্গ দিয়ে অস্ত্র পাচার করে বলে ইসরায়েলের তোলা অভিযোগ মিসর নাকচ করে বলেছে, তাদের দিকে মিসরের বাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে।
মিসরের কর্মকর্তারা আশঙ্কা করেন, যদি সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ভেঙ্গে পড়ে, তাহলে সিনাই এলাকায় মানুষের ঢল ঠেকানো সম্ভব হবে না।
ইসরায়েল গাজার প্রায় সবাইকে দক্ষিণে সরে যেতে বললেও তারা নিয়মিতভাবে রাফাসহ সব জায়গায় বিমান হামলা চালাচ্ছে। সম্প্রতি রাফায় বিমান হামলায় নারী এবং শিশুসহ কয়েক ডজন ফিলিস্তিনি নিহত হয়।