রমজানের খাদ্যপণ্য তবুও আস্থার সংকট বাজারে

রমজানের খাদ্যপণ্য তবুও আস্থার সংকট বাজারে

রোজা শুরু হতে এখনো কয়েক সপ্তাহ বাকি থাকলেও পবিত্র সংযমের মাসে খাদ্যসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার আগেভাগেই একগুচ্ছ উদ্যোগ নিয়েছে। এরইমধ্যে নানা কৌশলী পদক্ষেপ নিয়ে বাজার তদারকি সংশ্লিষ্ট ১৩টি সংস্থা মাঠে নেমেছে। শুল্ক কমানো হয়েছে ইফতারি সামগ্রীতে প্রয়োজনীয় বেশ কয়েকটি খাদ্যপণ্যের। রমজানে নিত্যপণ্যের বাজার লাগামহীন হবে না বলে আমলাদের পাশাপাশি বড় ব্যবসায়ীরাও আশ্বাস দিয়েছেন। প্রয়োজন হলে জরুরি আইন প্রয়োগ করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী।

তবে এরপরও রমজানে বাজার স্থিতিশীল থাকবে কিনা- তা নিয়ে কাটছে না আস্থার সংকট। বরং রোজা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নানামুখী শঙ্কা, সংশয় ও আস্থাহীনতা আরও বাড়ছে। সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে এবং ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এর স্পষ্ট চিত্র পাওয়া গেছে। বাজার পর্যবেক্ষকরাও ভোক্তার আস্থার সংকট বৃদ্ধির ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন।

ঢাকার মালিবাগ, কারওয়ান বাজার, যাত্রাবাড়ী, হাতিরপুল ও মালিবাগসহ একডজন পাইকারি ও খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, চিনি, সোয়াবিন তেল, ছোলা, ডাল, পেঁয়াজ ও খেজুরসহ রমজানে অধিক ব্যবহৃত পণ্যগুলো স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে। যেসব ক্রেতা সাধারণ সময় এসব পণ্য এক সঙ্গে এক-দেড় কেজি কিংবা দুই কেজি কিনতেন তারা এখন আড়াই-তিন কেজি করে কিনছেন।

এদিকে শুধু ভোক্তারাই নয়, মুদি দোকানি, হোটেল মালিক ও খুঁদে ব্যবসায়ীরাও এ ধরনের পণ্য বেশি পরিমাণে কিনে মজুত করছেন। তারা আগে সর্বোচ্চ ৫/৭ দিনে বিক্রি হয় ওই পরিমাণ মাল এক সঙ্গে কিনলেও এখন দুই-তিন সপ্তাহ কিংবা পুরো মাসের পণ্য কিনে রাখার চেষ্টা করছেন।

বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের আশঙ্কা, রমজানে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার সর্বোচ্চ কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিলেও প্রতিবারের মতো এবারও এর লাগাম টানতে ব্যর্থ হবে। আগে থেকেই চড়ে থাকা বাজার রোজার শুরুতেই পাগলা ঘোড়ার মতো উর্ধ্বশ্বাসে ছুটবে। সরকারের তদারকি সংস্থাগুলো বাজার নিয়ন্ত্রণে মাঠে থাকলেও সিন্ডিকেটের অপতৎপরতা পণ্ড করতে তারা কতটা সফল হবে তা নিয়েও সংশয়ে রয়েছেন ভোক্তারা।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এ বছর চাহিদা অনুযায়ী বাজারে পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে থাকবে প্রশাসন। রমজানে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের একাধিক মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থা বাজারে সার্বক্ষণিক নজরদারি করবে। রোজার সময় বাজার অশান্ত করতে নিত্যপণ্যের সরবরাহে বাধা সৃষ্টি, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি, অনৈতিক মুনাফা অর্জনসহ ভেজাল বিক্রিসহ নানা ধরনের অনিয়ম নিয়ন্ত্রণে এ সময় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জেল-জরিমানাসহ বিভিন্ন উপায়ে সাজা দেওয়ারও ব্যবস্থা থাকবে।

দাম বাড়াতে তৎপর অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি বন্ধে পুরো রমজান মাস জুড়ে বাজার তদারকি করবে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ২৮টি মনিটরিং টিম বাজারে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করবে। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি ও অবৈধ মজুতের বিরুদ্ধে চারটি গোয়েন্দা সংস্থাকে নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বাজার নজরদারিতে ঢাকা সিটি করপোরেশন, আনসার, নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর এবং জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের একাধিক টিম বাজার মনিটরিংয়ে কাজ করবে। বাজারে মনিটরিংয়ে থাকবে পুলিশ, বিজিবি ও র‌্যাবের বিশেষ টিম।

এদিকে আসন্ন রমজানে নিত্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক রাখতে ভোক্তা অধিদপ্তরের পাশাপাশি ডিএমপি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে বাজার মনিটরিং করবে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, আসন্ন রমজান সামনে রেখে কিছু সুযোগ সন্ধানী লোক গুজব ছড়িয়ে দ্রব্যমূল্য বাড়ানোর ফন্দি আঁটে। তাদের সে অপতৎপরতা রুখতে বেশকিছু কৌশলী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

বাজারে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে সুলভ মূল্যে বিপণন সক্ষমতা দ্বিগুণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে ভোগ্যপণ্য আমদানির বিষয়টিও নজরদারিতে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পণ্যের আন্তর্জাতিক দামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে খুচরা পর্যায়ের দাম নির্ধারণে যৌথ কমিটি কাজ শুরু করেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজা সামনে রেখে ভোজ্যতেল, চিনি, ডাল, পেঁয়াজ, ছোলা ও খেজুরের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে কাজ শুরু হয়েছে। খুব শিগগিরই টিসিবি এসব পণ্য নিয়ে ভ্রাম্যমাণ বাজার শুরু করবে। অনলাইন মার্কেটেও কিছু পণ্য বিক্রি হতে পারে। এছাড়া আমদানি প্রক্রিয়ায়ও বিশেষ নজর রাখা হচ্ছে।

কেননা প্রতি অর্থবছরে দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা ২১ লাখ টন, যার ৯০ শতাংশই আমদানি করতে হয়। কেবল রোজার মাসে ভোজ্যতেলের চাহিদা থাকে ৪ লাখ টনের মতো। সারা বছরের জন্য প্রয়োজন হয় ১৮ লাখ টন চিনি, এর মধ্যে ৩ লাখ টনের চাহিদা থাকে কেবল রোজার সময়। সারা বছর যেখানে ৫ লাখ টন মসুর ডাল লাগে, সেখানে শুধু রোজায় চাহিদা থাকে ৮০ হাজার টনের মতো। ফলে ডালের চাহিদা মেটাতে ৫০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। বছরে ৮০ হাজার টন ছোলার প্রয়োজন হয় দেশে, যার ৮০ শতাংশই ব্যবহার হয় রোজার মাসে। এ সময় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় পেঁয়াজের। ২৫ লাখ টন বার্ষিক চাহিদার ৫ লাখ টনই ব্যয় হয় রোজার সময়।

বাজার পর্যবেক্ষকরা জানান, চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় করে এসব পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা গেলে রমজানে মূল্যস্ফীতির ধারা ভেঙে দেওয়া সম্ভব। এজন্য সরাসরি বাজার তদারকির চেয়েও পণ্য আমদানি ও সরবরাহ ব্যবস্থায় কঠোর নজর দেওয়া জরুরি। অথচ প্রতিবছর রমজানে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন এ পদক্ষেপ গ্রহণে আশানুরূপভাবে সাফল্য অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে রোজা শুরুর আগেই সিন্ডিকেটের কারসাজিতে বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে।

ভোক্তাদের অভিযোগ, রমজানে নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে গত বছর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেল, র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি), কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনিটরিং টিম মাঠে নামে। এ সংস্থাগুলো খুচরা বাজার থেকে শুরু করে দেশের পাইকারি মোকামগুলোয় অভিযান চালায়, যাতে রমজানকে পুঁজি করে কারসাজির মাধ্যমে কেউ অতি মুনাফা লুটতে না পারে। কিন্তু তাতে বরাবরই খুব একটা সুফল মেলেনি। অসাধু ব্যবসায়ীরা যথারীতি নানা অজুহাতে ভোক্তাদের কাছে বাড়তি দামে পণ্য বিক্রি করেছে। তাই সরকারি ১৩ সংস্থা এবার মাঠে নামলেও তারা বাজার কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে তা নিয়ে জনমনে সংশয় দূর হয়নি। তাই আস্থার সংকটে থাকা ভোক্তারা রমজান শুরুর আগেই বিভিন্ন খাদ্যপণ্য আগের চেয়ে বেশি কিনে মজুত করছে। এতে এখুনি বাজার তেতে উঠেছে।

সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এর মধ্যেই বাড়তে শুরু করেছে মাংস-ডিম, আটা-ময়দা, ডাল-ছোলা, মসলা, চিনি ও খেজুরের দাম। যদিও দাম নিয়ন্ত্রণে চাল, চিনি, ভোজ্যতেল ও খেজুরের আমদানি শুল্ক কমিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর মধ্যে ভোজ্যতেলের দাম কেজি প্রতি ১০ টাকা কমানো হলেও তা কার্যকর হবে পহেলা মার্চ থেকে। এ অবস্থায় রোজার আগে তেলের মূল্য কমানোর প্রভাব আদৌ বাজারে পড়বে কিনা তা নিয়ে ভোক্তারা অনেকেই সন্দিহান। তাদের ভাষ্য, অতীতেও একাধিকবার তেলের দাম কমানো হলেও বাজারে পড়তি দরে তা কিনতে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। আগের দামে কেনা তেল বিক্রি শেষ না হওয়া এবং নতুন রেটের মাল সরবরাহ না হওয়ার অযুহাতে দোকানিরা দীর্ঘসময় বাড়তি দরে তেল বিক্রি করেছে।

এদিকে, বাজার সংশ্লিষ্ট ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখতে না পারলে শুল্ক ছাড়সহ নানা পদক্ষেপ নিয়েও বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না। সবার আগে সরবরাহ ব্যবস্থার দিকে নজর দিতে হবে।

অর্থনীতিবিদ মাহফুজ কবির বলেন, রমজান উপলক্ষে পণ্য আমদানিতে শুল্ক কমাতে দেরি হয়ে গেছে। এখন ব্যবসায়ী, ব্যাংক ও কাস্টমস মিলে দ্রুত পদক্ষেপ নিলে রমজানের বাজারে হয়তো ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, রমজানে বাজার নিয়ন্ত্রণে নানা রকম পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। বাজার নিয়ন্ত্রণে আশাবাদী বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থা। মূলত রোজায় বাজার শান্ত করতেই সরকার চিনি, ভোজ্যতেল, খেজুরসহ চার পণ্যে আমদানি শুল্ক ছাড় দিয়েছে। তবে শুল্ক ছাড়ের পাশাপাশি সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রয়েছে কিনা, সেদিকে নজর দেওয়া জরুরি।
তিনি বলেন, আমদানিকৃত ও দেশে উৎপাদিত পণ্য ঠিক মতো বাজারে পৌঁছাচ্ছে কিনা সেদিকেও নজর রাখতে হবে সরকারকে। সরবরাহ ঠিক থাকলে, কমে আসবে পণ্যের দাম। স্বস্তি পাবে ভোক্তা।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের নির্বাহী পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, কোনো কারণ ছাড়াই চালের দাম বাড়তে শুরু করেছে। আর চাল মূল্যস্ফীতিতে বড় ভূমিকা রাখে। সামনে রোজা। এই সময়ে ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে, বিশেষ করে আমদানি পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়।

তার মতে, বিবিএস মূল্যস্ফীতির যে হিসাব দেয় প্রকৃত মূল্যস্ফীতি আরও বেশি। নিম্নবিত্ত মানুষ খাদ্যপণ্যসহ যেসব পণ্য কেনে, তার দাম বেশি। ফলে তাদের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি। বাজার মনিটরিং ছাড়াও এখন অর্থনেতিক সংস্কারগুলো দ্রুত শুরু করা উচিত মনে করেন তিনি।

অর্থ বাণিজ্য শীর্ষ সংবাদ