রোজায় ব্যবহূত সব পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী

রোজায় ব্যবহূত সব পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী

কয়েক দিন পরই পবিত্র মাহে রমজান। রোজাকে পুঁজি করে সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়েছে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী ও সিন্ডিকেট চক্র। বিশেষ করে রোজায় ব্যবহূত সব পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। ছোলা, চিনি, বেসন, ডাল, মাছ মাংসের দাম যেন মরুভূমি পাড়ি দেয়া পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে চলেছে অবিরাম।
বাজার সিন্ডিকেট চক্রের টুঁটি চেপে ধরার যেন কেউ নেই। খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ আমাদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনকে রোজার আগে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কাজ করার নির্দেশ দেন।

বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেছেন, রমজান উপলক্ষে এবার কোনো পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ যথেষ্ট সরবরাহ আছে। তারপরও রমজানে পরিবহন ব্যবস্থা যাতে শৃঙ্খলিত থাকে ও সরবরাহে কোথাও প্রতিবন্ধকতা না হয় সেই বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসকদের পরামর্শ ও নির্দেশনা দিয়েছি। এদিকে রমজানকে ঘিরে মুসলিম পরিবারগুলোতে পুরোদমে চলছে প্রস্তুতি। রোজা শুরুর আগেই ছোলা, ডাল, চিনিসহ রোজায় ব্যবহূত প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন বিক্রেতারা। যদিও দফায় দফায় সরকারের ঘোষণা ছিল রোজায় নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো পণ্যের দাম বাড়বে না। সরকারের এমন ঘোষণার কোনো প্রতিফলন বাজারে দেখা যায়নি।

এদিকে টানা সাত মাস ধরে বিশ্ববাজারে কমছে খাদ্যপণ্যের দাম। অথচ দেশের বাজারে লাগামহীন দ্রব্যমূল্যের দাম। কয়েক সপ্তাহ ধরে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও কাঁচাবাজারে পণ্যের মূল্যে ঊর্ধ্বগতি। গত ফেব্রুয়ারি মাসকে হিসেবে ধরে জাতিসংঘ জানিয়েছে, টানা সাত মাসেরও বেশি সময় ধরে খাদ্যপণ্যের দাম হ্রাস অব্যাহত রয়েছে বিশ্ববাজারে। বৈশ্বিক এই সংস্থার খাদ্য ও কৃষি নিরাপত্তা-বিষয়ক অঙ্গ-সংগঠন ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন (ফাও) সম্প্রতি এক বিবৃতিতে এসব তথ্য জানিয়েছে। খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক বাজার বিশ্লেষণে ১৯৬২ সাল থেকে একটি বৈশ্বিক সূচক ব্যবহার করে আসছে ফাও। সেই সূচক বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শতকরা হিসেবে সব খাদ্যপণ্যের গড় দাম গত জানুয়ারির তুলনায় ফেব্রুয়ারিতে কমেছে দশমিক ৯ শতাংশ। বিবৃতিতে ফাও জানিয়েছে, ২০২৩ সালের জুলাই মাস থেকে বিশ্ববাজারে খাদ্যের দাম কমা শুরু হয়েছে এবং ফেব্রুয়ারি মাসকে হিসেবে ধরা হলে গত সাত মাসে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের দাম ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ, ভোজ্যতেলের দাম ১১ শতাংশ এবং মাংসের দাম দশমিক ৮ শতাংশ কমেছে। তবে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম কমলেও বেড়েছে চিনির দাম। ফাও সূচকের তথ্য অনুযায়ী, গত সাত মাসে বিশ্ববাজারে চিনির দাম বেড়েছে ১২ শতাংশ। বিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশে একটানা বেড়ে চলছে নিত্যপণ্যের দাম।

রমজানকে সামনে রেখে সরকার চিনির আমদানি শুল্ক কমিয়েছে। কিন্তু এখনো এর প্রতিফলন দেখেনি ভোক্তারা। সূত্র থেকে জানা যায়, দেশে বছরে চিনির চাহিদা ২০ লাখ টন। স্বাভাবিক সময়ে মাসে চাহিদা থাকে দেড় লাখ টন। আর রমজানে চাহিদা তিন লাখ টন। চট্টগ্রাম কাস্টমস থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত আট মাসে (২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) দেশে চিনি আমদানি হয়েছে ১৪ লাখ ১৮ হাজার ৬৩০ টন। আর রোজা ঘিরে শেষ তিন মাসে আমদানি হয়েছে এক লাখ ৬০২ টন। এর বাইরে খালাসের অপেক্ষায় রয়েছে আরও প্রচুর চিনি। তারপরও বাজারে বেড়ে চলেছে পণ্যটির দাম। এদিকে সরকার চিনির আমদানি শুল্ক কমালেও বাজারে এর কোনো প্রভাব নেই। উল্টো দাম বাড়ার প্রবণতা দেখা গেছে। এর ওপর নতুন করে এস আলমের চিনিকলের অগ্নিকাণ্ডকে পুঁজি করে বাজারে চিনির কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়েছে। সরেজমিন দেখা গেছে, এক সপ্তাহ আগে খোলা চিনি কেজিপ্রতি বিক্রি হয়েছে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা পর্যন্ত, রোজার আগ মুহূর্তে কেজিপ্রতি চিনির দাম উঠেছে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকা।

রোজা শুরু হওয়ার আগেই বেড়েছে মাছ-মাংস ও সব ধরনের সবজির দাম। বাজার করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে নিম্নবিত্ত মানুষ। তারা বলছেন, এভাবে দাম বাড়তে থাকলে শাক-সবজি খেয়েও রোজা রাখা দায় হয়ে পড়বে। গতকাল বাজারে তেলাপিয়া মাছের কেজি ২০০ টাকা, পাঙাসের কেজি ১৮০ টাকা, টেংরার কেজি ৫৬০ টাকা, ছোট রুই ৩১০ থেকে ৩২৯ টাকা, ইলিশের কেজি এক হাজার ৬০০ টাকা, শিং মাছ ৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এর বাইরে ছোট কাচকি ২৯০ থেকে ৩২০ টাকা, আইড় মাছ ৪০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হতে দেখা গেছে। বর্তমানে খুচরা বাজারগুলোতে ব্রয়লার মুরগি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকায়। অথচ সপ্তাহখানেক আগেও এই মুরগি পাওয়া গেছে ১৯০-২০০ টাকায়। লেয়ার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩২০ টাকায়। বেড়েছে ডিমের দামও। যদিও বাজার ভেদে দেখা গেছে দামের ভিন্নতা। বড় বাজারগুলোতে ৪৮ টাকা আর এলাকা বা মহল্লার দোকানগুলোতে ৫০ টাকা হালিও ডিম বিক্রি হচ্ছে। আর গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ থেকে ৭৬০ টাকায় কেজিতে।

রাজধানীর হাতিরপুলের এক ক্রেতা বলেন, যেভাবে দাম বাড়ছে রমজানে ব্রয়লার মুরগি দাম ২৬০-২৭০ টাকা হয়ে যাবে। ফলে, আমাদের মতো মানুষের জীবন বাঁচানো কষ্ট হয়ে যাবে। ছেলে-মেয়েদের মাছ-মাংস খাওয়ানো যাবে না। সবজি দিয়ে ভাত দিতে পারব কি-না জানি না। তিনি আরও বলেন, সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ কমপক্ষে রমজানে বাজার যেন কঠোরভাবে মনিটরিং করে। শুধু মাছ-মাংস নয়, পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলছে সবজির দামও। গত সপ্তাহে তুলনায় প্রতিটি সবজিতে প্রকারভেদে দাম বেড়েছে পাঁচ থেকে ১০ টাকা। আর বিক্রেতারা বলছেন, শীত শেষ এখন দিন দিন সবজির সরবরাহ কমছে। তাই দাম একটু তো বাড়বেই। বাজারের চাহিদার তুলনায় সবজির সরবরাহ কম। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, আলু বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়, কাঁচামরিচ ৮০ টাকা, লাউ প্রতিটি ৫০ টাকা, বেগুন লম্বা ৮০ টাকা, গোল বেগুন ১০০ টাকা, ফুলকপি প্রতিটি ৬০ টাকা, টমেটো ৫০ টাকা, বাঁধা কপি ৫০ টাকা, শিম প্রকারভেদ ৪০ থেকে ৬০ টাকা, ঢেঁড়স ৮০ টাকা, করলা ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এর বাইরে শিমের বিচি কেজি ২২০ টাকা, মটরশুঁটি ১৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।

রমজানের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় দ্রব্য ছোলা। রমজান উপলক্ষে ভারত থেকে এক সপ্তাহে এক হাজার ৪০৩ টন ছোলা আমদানি করা হয়েছে। সরকার ব্যবসায়ীদের শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচা ছোলা আমদানির সুযোগ দিলেও তার সুফল পাচ্ছেন না ক্রেতারা। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ছোলা বিক্রি হচ্ছে ১০৫ থেকে ১১০ টাকা কেজি দরে। গত বছর বাজারে এ সময় ছোলার কেজি ছিল ৯০ থেকে ৯৫ টাকা। সেই হিসাবে এবার কেজিতে দাম বেড়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান মুঠোফোনে আমার সংবাদকে বলেন, আমরা নিয়মিত বাজারে অভিযান পরিচালনা করাছি। আসন্ন রোজা উপলক্ষে বাজার মনিটরিং আরও জোরদার করা হবে। স্থানীয় প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে কাজ করছেন বলেও জানান সংস্থাটির প্রধান।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, রমজান এলেই এক শ্রেণির অসাধু সিন্ডিকেট জড়িত। বাড়তি দামের পেছনে সাধারণ মানুষেরও অনেকটা দায় আছে। প্রত্যেকটা পরিবারেই দেখবেন রোজা আগ মুহূর্তে অন্তত এক সপ্তাহ-দশ দিনের বাজার কিনে জমিয়ে রাখা হয়। যে কারণে ওই সময়টাতে বাজারে পণ্যের চাহিদা অনেকগুণ বেড়ে যায়। আর এ সুযোগটা গ্রহণ করেন মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা।

অর্থ বাণিজ্য শীর্ষ সংবাদ