নিজস্ব প্রতিবেদক
ঢাকার গুলশানে সাবেক সংসদ সদস্য তানভীর ইমামের সাবেক স্ত্রীর বাসা লুট হয়। গত ৪ মার্চ ‘অবৈধ অস্ত্র ও ছাত্র-জনতার হত্যাকারীরা’ লুকিয়ে আছে এমন কথা রটিয়ে ‘মব’ সৃষ্টি করে লুট করা হয়। এই ঘটনার নেপথ্যে ছিলেন ‘জাতীয়তাবাদী চালক দল’-এর সাধারণ সম্পাদক জুয়েল খন্দকার ও তার ছেলে শাকিল খন্দকার। গত ১০ মার্চ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশে জাতীয়তাবাদী চালক দলের জুয়েল খন্দকার ও শাকিল খন্দকারের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করে বিএনপি।
গত ২৪ মার্চ জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া সংগঠন তৈরির অভিযোগে ‘জিয়া প্রজন্ম’ ও ‘জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম পরিষদের’ তিন নেতার বিরুদ্ধে মামলা হয়। এই মামলাও হয় তারেক রহমানের নির্দেশে।
গত ৩ মার্চ বিএনপি জানায়, জিয়া প্রজন্ম দল নামে একটি ভুয়া সংগঠনের মহাসচিব হিসেবে সারোয়ার হোসেন রুবেল নানা ধরনের অপকর্মে লিপ্ত রয়েছেন। তিনি বিএনপির বর্ধিত সভায় অংশগ্রহণের জন্য ভুয়া পরিচয়পত্র তৈরি করে সভায় প্রবেশের চেষ্টা করেছেন। বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সঙ্গে উল্লিখিত সারোয়ার হোসেন রুবেলের কোনো সম্পর্ক নেই।
বিএনপি বলছে, দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ভুঁইফোঁড় সংগঠন। দীর্ঘদিন বিএনপি ক্ষমতার বাইরে থাকায় অনেকটা গর্তে ঢুকে ছিল এই সংগঠনগুলো। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এই সংগঠনগুলো আবারও সক্রিয় হতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে বিএনপির নাম ব্যবহার করে চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে বেশ কিছু সংগঠনের বিরুদ্ধে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশে একাধিক ভুয়া সংগঠনের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে। বিএনপির সুনাম ক্ষুণ্ন করার চেষ্টাকারীদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। শুধু তাই নয়, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করায় দলের ৩ হাজারের অধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে বিএনপি। অনেক আগেই জিয়া-খালেদা জিয়া-তারেক রহমানের নাম ব্যবহার করে ‘ভুঁইফোঁড়’ সংগঠন সৃষ্টির বিরুদ্ধে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। দলে যোগদান অনুষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। যেখানে দলীয় নেতাকর্মীরা ছাড় পাচ্ছে না, সেখানে ভুয়া সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে আরও কঠোর হবে বিএনপি।
জানা গেছে, বিএনপির ভুঁইফোঁড় অর্ধশতাধিক সংগঠন রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক দল, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক একাডেমি, সম্মিলিত সমন্বয় পরিষদ, জিয়া নাগরিক ফোরাম, জিয়া আদর্শ একাডেমি, তৃণমূল দল, জিয়া সেনা, স্বদেশ জাগরণ পরিষদ, দেশনেত্রী সাংস্কৃতিক পরিষদ, দেশপ্রেমিক ফোরাম, জিয়া স্মৃতি সংসদ, চেতনায় ৭১, সচেতন নাগরিক ফোরাম, চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ, নাগরিক অধিকার সোসাইটি, গণতান্ত্রিক ঐক্য ফোরাম, গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক জোট, জাগ্রত জনতা ফোরাম, নাগরিক পরিষদ, গণমুক্তি আন্দোলন পরিষদ, প্রজন্ম একাডেমি, নাগরিক সংসদ, সুশীল ফোরাম, নাগরিক অধিকার বাস্তবায়ন পরিষদ, চিরন্তন বাংলাদেশ, হৃদয়ে বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইয়ুথ ফোরাম, তৃতীয় স্বর, দেশপ্রেমিক যুবশক্তি, নাগরিক ফোরাম, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক জোট, সচেতন নাগরিক পরিষদ, গ্রুপ-৯, আমরা ঢাকাবাসী, বাংলাদেশ সচেতন যুব সমাজ, সচেতন দেশপ্রেমিক, ফোরাম, জিয়া নাগরিক সংসদ, সামাজিক আন্দোলন সংস্থা, গণতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম, সচেতন যুব সমাজ, স্বদেশ মঞ্চ, জিয়া ব্রিগেড, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী সেবা দল, জাতীয়তাবাদী বন্ধু দল, ডেমোক্রেটিক কাউন্সিল, নাগরিক মঞ্চ, সমবায় দল, জাতীয়তাবাদী দেশ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও আন্দোলন, জাতীয় মানবাধিকার সমিতি, জিয়া ন্যাশনালিস্ট ফোরাম, বাংলাদেশ উন্মুক্ত গণতান্ত্রিক পরিষদ, বাংলাদেশ সচেতন যুব সমাজ, বাংলাদেশ মানবাধিকার ফোরাম, জাতীয়তাবাদী মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম, চেতনায় মুক্তিযোদ্ধা, জাতীয়তাবাদী নাগরিক সংসদ, জাতীয়তাবাদী বাউল দল, জাতীয়তাবাদী কর্মজীবী কল্যাণ পরিষদ, খালেদা জিয়া মুক্তি পরিষদ, তারেক রহমান মুক্তি পরিষদ, তারেক রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সংগ্রাম পরিষদ, শহিদ জিয়াউর রহমান আদর্শ বাস্তবায়ন পরিষদ, জাতীয়তাবাদী কৃষি আন্দোলন, জনতার ধ্বনি, আজকের প্রজন্ম।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এগুলোর মধ্যে কিছু সংগঠনের অস্তিত্ব নেই। এসব সংগঠনের অধিকাংশই প্রেস ক্লাব এলাকায় তৎপর। এদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিএনপি নেতাদের অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। পরে অনুষ্ঠানের ছবিকে পুঁজি করে বিভিন্ন তদবির ও চাঁদাবাজিকে জড়িয়ে পড়েন সংগঠনের নেতারা। এখন বিএনপির প্রভাব সর্বত্র। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি ও বিএনপি নেতাদের নাম ভাঙিয়ে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত তারা।
তবে একাধিক সংগঠনের নেতা দাবি করেন, গত ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিল না বিএনপি। আওয়ামী লীগের শাসনামলে ঠিকমতো রাজনৈতিক কর্মসূচিও পালন করতে পারত না। তখন এই বিএনপিঘেঁষা সংগঠণগুলোর ব্যানারেই বিএনপি নেতারা কথা বলতেন, জনগণের কাছে দলের বক্তব্য তুলে ধরতেন। কেউ কেউ অন্যায়ে জড়িত থাকতে পারে। সবাই খারাপ না।
এদিকে বিএনপির দফতর সূত্রে জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর থেকে সারা দেশে সুবিধাবাদী আর হাইব্রিড নেতাকর্মীদের অপতৎপরতা বেড়েছে। সুবিধাবাদী-হাইব্রিড নেতারা এখন দখল, টেন্ডার ও চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে। গত সাত মাসে তিন সহস্রাধিক নেতাকর্মীর পদ স্থগিত ও দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এর মধ্যে বিএনপি ১ হাজার ৮০০ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে। এদের অন্তত ৭৫০ জনকে কারণ দর্শানো নোটিস, ৮০০ জনকে বহিষ্কার, ৫০ জনের পদ স্থগিত, অন্তত ১০০ জনকে সতর্ক এবং ১৫০ জনকে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের নোটিস দেওয়া হয়েছে। সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলও এ পর্যন্ত ৪০০ জনকে বহিষ্কার ও ৬০০-এর অধিক নেতা-কর্মীকে কারণ দর্শানো নোটিস দিয়েছে। অঙ্গসংগঠন স্বেচ্ছাসেবক দলের অন্তত ১০০ জনকে বহিষ্কার ও ১৫০ জনকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়েছে। যুবদলেরও শতাধিক নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
বিএনপির প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাহউদ্দিন (টুকু) সময়ের আলোকে বলেন, এসব ভুয়া সংগঠনকে ইতিমধ্যে দলের পক্ষ থেকে সতর্ক বার্তা দেওয়া হয়েছে। দলের নেতাকর্মীদের এসব ভুয়া সংগঠনের সঙ্গে জড়িত না হতে বলা হয়েছে। ইতিমধ্যে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ এ বিষয়ে স্টেটমেন্ট দিয়েছেন।
তিনি বলেন, এসব ভুয়া সংগঠন ও হাইব্রিডরা সবসময় সুযোগসন্ধানী, নিজেরা ত্যাগ স্বীকার করে না; কিন্তু সুবিধা নেওয়ার বেলায় এগিয়ে থাকে। এসব ভুয়া সংগঠনের দায় আমরা নেব না। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, হবে।
বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল সময়ের আলোকে বলেন, জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া সংগঠন তৈরি এবং বিএনপির নাম ভাঙিয়ে অপকর্ম করার বিষয়গুলো বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নজরে আসে। তিনি কথিত ভুয়া সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী মামলা করা হয়েছে।
কায়সার কামাল আরও বলেন, ভবিষ্যতে যারা বিএনপির নাম ভাঙিয়ে ভুয়া সংগঠন কিংবা দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করবে, তাদের বিরুদ্ধেও একই রকমের আইনগত ব্যবস্থা নেবে বিএনপি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সময়ের আলোকে বলেন, বিএনপির সঙ্গে এসব ভুঁইফোঁড় সংগঠনের কোনো সম্পর্ক নেই। দলের যেকোনো পর্যায়ের নেতাকর্মীদের এসব অননুমোদিত সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গেলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
তিনি বলেন, বিভিন্ন জায়গায় বিএনপির নাম ভাঙিয়ে অনেকে অনেক অপকর্ম করছেন। যাদের সঙ্গে বিএনপির ন্যূনতম কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। এসব বিষয়ে তারা যথেষ্ট সজাগ রয়েছেন।