আন্তর্জাতিক যে কারণে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হলো ভারত-পাকিস্তান

আন্তর্জাতিক যে কারণে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হলো ভারত-পাকিস্তান

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

 

চার দিন ধরে চলা ভয়াবহ পাল্টাপাল্টি হামলার পর অবশেষে ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে। গত শনিবার সন্ধ্যায় দুই দেশের মধ্যে এই তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। বিশ্লেষকদের মতে, দুই দেশের পরমাণু সক্ষমতা ও উত্তেজনার ক্রমবর্ধমান মাত্রা বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ তৈরি করেছিল। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় সংঘর্ষে সাময়িক বিরতি এলেও—যুদ্ধবিরতির প্রক্রিয়া ও কৃতিত্ব নিয়ে দুই প্রতিবেশীর ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ ভিন্ন।

হঠাৎ যুদ্ধবিরতির ঘোষণা

যুক্তরাষ্ট্রের সময় সকাল ৮টার কিছু আগে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যাল-এ লেখেন, ‘দীর্ঘ রাতের আলোচনার পর আমি আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, ভারত ও পাকিস্তান একটি সম্পূর্ণ ও তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে।’ তিনি দুই দেশের নেতাদের ‘সাধারণ জ্ঞান ও চমৎকার বুদ্ধিমত্তার’ প্রশংসাও করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এ ঘোষণাকে আরও বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করে বলেন, শুধু যুদ্ধবিরতি নয়—ভারত ও পাকিস্তান একটি নিরপেক্ষ স্থানে বিস্তৃত আলোচনা শুরু করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি জানান, গত দুই দিন তিনি ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স উভয় দেশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রেখেছেন। পাকিস্তান তাৎক্ষণিকভাবে যুদ্ধবিরতির বিষয়টি নিশ্চিত করে। কিছুক্ষণ পর ভারতও এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়।

কৃতিত্ব ঘিরে দ্বিমত

যদিও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও মার্কো রুবিও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার ওপর জোর দিয়েছেন, তবে ভারতের তথ্য মন্ত্রণালয় বলছে, যুদ্ধবিরতির এই সিদ্ধান্ত দুই দেশের সরাসরি আলোচনার মাধ্যমেই হয়েছে। তারা পরবর্তী কোনো আলোচনা হবে কিনা সে বিষয়ে ‘কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি’ বলেও জানায়।

অন্যদিকে পাকিস্তান পুরো বিষয়টিতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার প্রশংসা করেছে। প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বলেন, ‘এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নেতৃত্ব ও সক্রিয় ভূমিকায় আমরা কৃতজ্ঞ।’পাকিস্তানের এক সূত্র সিএনএনকে জানান, মার্কো রুবিওর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চুক্তি অনিশ্চিত অবস্থায় ছিল।

ভিন্ন অবস্থান: কেন?

বিশ্লেষকদের মতে, এই ভিন্ন ব্যাখ্যার পেছনে রয়েছে দুই দেশের মৌলিক কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। ভারত দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার বিরোধী। ওয়াশিংটনের হাডসন ইনস্টিটিউটের গবেষক ড. অপর্ণা পান্ডে বলেন, ‘ভারত কখনোই কোনো দ্বন্দ্বে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা মেনে নেয় না, হোক তা পাকিস্তান, চীন কিংবা অন্য যে কোনো দেশের সঙ্গে।’তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান সবসময় আন্তর্জাতিক সহায়তা চায়, কারণ সেটিই একমাত্র উপায় যেটি ব্যবহার করে তারা কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।’

সংঘর্ষ যেভাবে শুরু

এই উত্তেজনার সূত্রপাত ২৬ এপ্রিল, কাশ্মীরের পাহালগামে পর্যটকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা থেকে। সেখানে ২৫ জন ভারতীয় এবং একজন নেপালি নিহত হন। ভারত হামলার জন্য সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করে। এরপর দুই সপ্তাহ পর ভারত ‘অপারেশন সিঁদুর’ চালায়, যার আওতায় পাকিস্তান এবং পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরে বিমান হামলা চালানো হয়।

পাকিস্তান পাল্টা জবাব দেয়। শনিবার সকালের দিকে ইসলামাবাদ-সংলগ্ন ঘাঁটি পর্যন্ত ভারতীয় হামলার অভিযোগ তোলে পাকিস্তান। জবাবে পাকিস্তানও ভারতের সামরিক ঘাঁটিতে মিসাইল হামলা চালায়। সেনাবাহিনীর ভাষায়, ‘চোখের বদলে চোখ।’

এই হামলার পর শ্রীনগর ও জম্মুতে বিস্ফোরণের খবর পাওয়া যায়। প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ বলেন, ‘ভারতের আগ্রাসনের জবাবে পাকিস্তান যথাযথ প্রত্যুত্তর দিয়েছে।’

যুক্তরাষ্ট্র হঠাৎ কেন সক্রিয় হলো?

মাত্র দুই দিন আগেও ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স বলেছিলেন, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ‘যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি বিষয় নয়।’ কিন্তু শুক্রবার নতুন গোয়েন্দা তথ্য আসার পর পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করে যুক্তরাষ্ট্র আলোচনায় সক্রিয় ভূমিকা নেয়। স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তারা জানান, সংঘাত ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছাতে পারে এমন তথ্য পাওয়ার পর তারা দ্রুত হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেন।

যুদ্ধবিরতির ভবিষ্যৎ কি?

যুদ্ধবিরতির কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কাশ্মীরের উভয় অংশে বিস্ফোরণের খবর পাওয়া যায়। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিসরি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একাধিকবার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ আনেন। পাকিস্তানও ভারতকে একই অভিযোগে দায়ী করে। তবে দেশটি জানায়, ‘আমরা চুক্তি পালনে আন্তরিকভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’

এই উত্তেজনার মধ্যে দুই দেশই একে অপরের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক ব্যবস্থা নিয়েছে—যেমন, ভিসা স্থগিত, বাণিজ্য বন্ধ এবং ভারতের পানিবণ্টন চুক্তি থেকে সরে আসা। এই সিদ্ধান্তগুলো ফিরিয়ে নেওয়া হবে কি না, সেটি এখনও অনিশ্চিত।

আন্তর্জাতিক শীর্ষ সংবাদ