ঋণের সুদ ৯% না করলে সরকারি তহবিল নয়

জামাল উদ্দীন

ব্যাংক ঋণের সুদ হার কমাতে নতুন নির্দেশনা জারি করেছে সরকার। যেসব ব্যাংক সিঙ্গেল ডিজিট তথা ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দেবে না, সেসব ব্যাংক আমানত হিসেবে সরকারি তহবিলের অর্থ পাবে না। এমনকি যারা ইতোমধ্যে ৯ শতাংশে ঋণের সুদ হার নামিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছে সেসব ব্যাংকও এ সুবিধা পাবে না। গতকাল সোমবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে এমন কঠোর নির্দেশনা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্র জানায়, সুদের হার কমিয়ে আনতে সরকার কঠোর অবস্থানে রয়েছে। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও নানা সুবিধা নিয়েও ব্যাংকগুলো এতদিন তা কার্যকর করেনি। কয়েকটি সরকারি ব্যাংক তা মানলেও বেসরকারি ব্যাংকগুলো উল্টো সুদের হার বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা নানা অজুহাতে সুদ হার শুধু বাড়ায়নি, গ্রাহকদের ওপর নানা ধরনের চার্জও আরোপ শুরু করে। লুক্কায়িত নানা চার্জে গ্রাহকদের নাভিশ্বাস উঠেছে। বিশেষত সত্ ও প্রকৃত উদ্যোক্তা, ভোক্তা ঋণগ্রহীতারা ঋণের আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে যাচ্ছে। অথচ সুদ হার কমানোর ঘোষণা ব্যাংক মালিকরাই ঘটা করে দিয়েছিলেন। সেজন্য তারা বেশ কয়েকটি সুবিধাও সরকারের কাছ থেকে আদায় করে নেন। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা, সিআরআর এক শতাংশ কমানো, ঋণ আমানতের হার (এডিআর) সমন্বয়সীমার সময় বাড়ানো এবং রেপো রেট ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশ করা। এসব সুবিধা নেওয়ার পরও ব্যাংকগুলো সিঙ্গেল ডিজিটে সুদ হার আরোপ করেনি বরং নতুন নতুন অজুহাত দাঁড় করিয়ে সুদ হার বাড়িয়েছে। যা কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধির পরিপন্থি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রজ্ঞাপনে যা রয়েছে : অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের উপসচিব জেহাদ উদ্দিনের স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় সরকার থেকে প্রাপ্ত তহবিল, সরকারি, আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠান, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার মোট নিজস্ব তহবিলের অর্থ ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ৬ শতাংশের বেশি হারে আমানত রাখা যাবে না। প্রজ্ঞাপনে আরো বলা হয়, যেসব ব্যাংক গত ২ আগস্ট ২০১৮ সালের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ঋণের সুদ হার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছে তারা এ সুবিধা প্রাপ্য হবে না। নির্দেশনাটি গতকাল জারির সময় থেকেই কার্যকর হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর ফলে শিল্প-বাণিজ্যে গতি আসবে। বর্তমানে জ্বালানি সংকটসহ অন্যান্য সমস্যা মোকাবিলার পর বাড়তি সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন গ্রাহকরা। গত বছর কয়েকটি ব্যাংক সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামানোর ঘোষণা দিলেও কার্যত তা ছিল ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’। ক্ষেত্রবিশেষে ‘প্রভাবশালী কিছু বড় গ্রাহক’ এ সুবিধা পেলেও সবক্ষেত্রে সুদের হার কমানো হয়নি। কোনো কোনো ব্যাংক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে কম সুদ হারের ঘোষণা দিলেও বাস্তবে গ্রাহকরা ব্যাংকে গেলে তার বিপরীত চিত্র দেখতে পান। সার্ভিস চার্জসহ নানা ফি আরোপ করা হয়। কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে সুদের ওপর সুদ বা দণ্ডসুদও প্রয়োগ করা হয়। সূত্রমতে, সেই ‘কাবুলিওয়ালা’দের মতোই ব্যাংকগুলোর আচরণ। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এ অবস্থাকে ব্যাংকগুলোর ‘ডাকাতি কারবার’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।

প্রতিশ্রুতি রাখেনি ব্যাংকগুলো : বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী এ প্রসঙ্গে ইত্তেফাককে বলেন, উদ্যোক্তা বিকাশে বাংলাদেশ ব্যাপক সম্ভাবনাময়। কিন্তু উচ্চ সুদ হার ও জ্বালানি সংকটে এখানে ব্যবসা-শিল্প গড়া অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। বেসরকারি ব্যাংক মালিকদেরও শিল্প-কারখানা রয়েছে। তথাপি তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েও ব্যাংক ঋণের সুদ হার কমায়নি। তিনি বলেন, সরকারের সর্বশেষ এ উদ্যোগ দেশে শিল্প বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তিনি একই সঙ্গে সুদের ‘সিম্পল রেট’ বাস্তবায়ন করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। যা অর্থমন্ত্রী ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে সুদের হার বেশি হওয়ায় বরাবরই এর সমালোচনায় ছিলেন উদ্যোক্তারা। বেশি সুদ হওয়ায় ব্যবসা পরিচালনার ব্যয়ও বেড়ে যায়। যা প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারে টিকে থাকার ক্ষেত্রেও চ্যালেঞ্জ ছিল। অন্যদিকে সরকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগকে উত্সাহ দিতে বদ্ধপরিকর। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) প্রতিষ্ঠান উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসায় টেকসই হতে পারে না।

এদিকে অপর একটি সূত্র জানায়, অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ঋণের সুদ হিসাব করার ক্ষেত্রে ‘সিম্পল রেট’ বা সরল সুদ হার চালুর ঘোষণা শিগগিরই দেওয়া হবে। এজন্য আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া চলছে। যা একটি গতিশীল অর্থনীতির দিকে নিয়ে যাবে দেশকে।

অর্থ বাণিজ্য জাতীয় শীর্ষ সংবাদ