দুবছরে সহস্রাধিক রোহিঙ্গা পাচার করে ইব্রাহিম চক্র

কামরুজ্জামান খান :

মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা টেকনাফ ও উখিয়ার নির্দিষ্ট ক্যাম্পে থাকতে চাইছে না। কাজের সন্ধানে অনেকে যেমন ক্যাম্পের বাইরে বের হতে চাইছে, কেউ কেউ আবার নিরাপদ ভবিষ্যতের আশায় বিদেশ পাড়ি দেয়ার সুযোগ খুঁজছে। নানা কায়দায় রোহিঙ্গাদের বিদেশে পাঠাতে সক্রিয় পাচারকারীরাও। আকাশ ও সমুদ্রপথে রোহিঙ্গা পাচারে সক্রিয় একাধিক চক্রের তালিকা পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এই চক্রের কক্সবাজার, টেকনাফ, ঢাকা, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় রয়েছে নেটওয়ার্ক। ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গা সংগ্রহ, ঢাকায় আনা, ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে বাংলাদেশি পাসপোর্ট তৈরি, ভিসা প্রসেসিং ও বিমানে তুলে দিতে নির্দিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত পৃথক এজেন্ট রয়েছে। বিশাল এই মানব পাচারকারী চক্রের একটি গ্রুপ গত দুই বছরে সহস্রাধিক রোহিঙ্গাকে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় পাঠিয়েছে বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে। এই চক্রের মাস্টারমাইন্ড হাজি ইব্রাহিম খলিল ও সবুর ওরফে রহিমের ঢাকা, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় হরদম যাতায়াত রয়েছে। টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গা সংগ্রহকারী আইয়ুব মোস্তাকিন ঢাকার খিলক্ষেতে ২৩ রোহিঙ্গাসহ আটকের পর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানিয়েছেন চাঞ্চল্যকর তথ্য। খিলক্ষেত থানায় দায়েরকৃত মামলার তদন্ত করছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পশ্চিম শাখার পরিদর্শক লিয়াকত হোসেন।
ডিবি পশ্চিম শাখার উপকমিশনার মোহাম্মদ মোখলেছুর রহমান জানান, খিলক্ষেতে উদ্ধারকৃত ৫৬টি পাসপোর্ট যাচাই করা জরুরি। এ ব্যাপারে এসবির রিপোর্ট হাতে পেলে তদন্তের একটি লাইনআপ তৈরি হবে। এ ছাড়া রোহিঙ্গা পাচারে মাস্টারমাইন্ডদের আটকে অভিযান চলছে।
ডিবি পশ্চিম বিভাগের মাদক উদ্ধার টিমের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) হান্নানুল ইসলাম খিলক্ষেতে রোহিঙ্গা আটক অভিযানে নেতৃত্ব দেন। গতকাল সোমবার বিকেলে তিনি ভোরের কাগজকে জানান, গ্রেপ্তারের পর আইয়ুব (সিনিয়র রোহিঙ্গা) প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রোহিঙ্গা পাচারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। পরে তিনি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। আইয়ুব পুলিশকে জানান, গত দুই বছরে তারা সহস্রাধিক রোহিঙ্গাকে বিদেশে পাঠিয়েছেন। তাদের মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া পাঠানো হয়। আইয়ুব মূলত ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গা সংগ্রহের দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশে এই চক্রের হোতা হাজি ইব্রাহিম খলিল ও সবুর ওরফে রহিম। তাদের মালয়েশিয়ায় ও ইন্দোনেশিয়ায় এজেন্ট রয়েছে। ইব্রাহিম খলিল মালয়েশিয়ায় অবস্থান করলেও বাংলাদেশে ফিরেছেন বলে জানা গেছে। তাকে ধরতে বিমানবন্দর ইমিগ্রেশন পুলিশে যোগাযোগ করা হয়েছে। গোয়েন্দা পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান, মূল হোতা ইব্রাহিম খলিল ও রহিমকে ধরা গেলে রোহিঙ্গা পাচারের পুরো চক্রকেই ধরা যাবে। ঢাকায় আনা, পাসপোর্ট তৈরি ও বিদেশে পাচারের জন্য টাকার ব্যাপারে একেক জনের কাছ থেকে একেক রেট নেয়া হয়। ইব্রাহিম খলিল রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সরাসরি চুক্তি করেন।
ডিবি পশ্চিমের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত ১০ মে ভোরে খিলক্ষেতের নামাপাড়ার কোহিনুর ভিলা থেকে ২৩ রোহিঙ্গাসহ ২৭ জনকে আটক করা হয়। রোহিঙ্গা আইয়ুব মোস্তাকিম, তার স্ত্রী আসমা আক্তার, দালাল মোশারফ হোসেন শিপন ও খিলক্ষেতের বাড়ির মালিক ওয়ালিদ হোসেন কাজলকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ১১ মে তাদের আদালতের নির্দেশে এক দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আদালতের নির্দেশে ২৩ জন রোহিঙ্গাকে টেকনাফ ও উখিয়ার আশ্রয় শিবিরে ফেরত পাঠানো হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধারের পর রোহিঙ্গাদের নামে করা ৫৬টি পাসপোর্ট জাল কিনা, তা যাচাই করতে পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) চিঠি দেয়া হয়েছে। তবে এসবি থেকে ওই চিঠির জবাব এখনো মেলেনি। এই পাসপোর্ট তৈরির সঙ্গে কারা, কীভাবে জড়িত, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পাচারকারী চক্রটির সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে অন্তত এক ডজন দালাল জড়িত বলে তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। রোহিঙ্গা সংগ্রহে তিনি কীভাবে দালালদের সাহায্য করেন, পুলিশকে সেই তথ্য জানিয়েছেন আয়েশা নামে এক রোহিঙ্গা নারী।
এদিকে গত রবিবার সকালে গালফ এয়ারের একটি বিমানে সৌদি আরব যাওয়ার সময় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে এক দালালসহ চার রোহিঙ্গাকে আটক করে গোয়েন্দারা। আরিফা বেগম, মনিকা হোসেন, সানোয়ারা বেগম, মোহাম্মদ ওমর নামের ওই চার রোহিঙ্গা ঢাকার বিভিন্ন স্থানের ঠিকানা ব্যবহার করে বাংলাদেশি পাসপোর্ট সংগ্রহ করেছিলেন।
আটকের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে দালাল আফসার উদ্দিন পুলিশকে জানায়, দেশি-বিদেশি চক্রের মাধ্যমে ক্যাম্প থেকে তারা রোহিঙ্গা সংগ্রহ করেন। এরপর পাসপোর্ট তৈরি করে ভিসা প্রসেসিং করানোর পর ভাষা সম্পর্কে জ্ঞানদান করিয়ে বিদেশে পাঠানো হয়।
অন্যদিকে অবৈধভাবে সাগরপথে মালয়েশিয়া পাচারের সময় ৮৪ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করেছে কোস্ট গার্ড ও পুলিশ। এ সময় মানব পাচারকারী দলের পাঁচজনকে আটক করা হয়েছে। ১৭ মে শুক্রবার সেন্টমার্টিন দ্বীপের দক্ষিণ সৈকত এলাকা ও পেকুয়া উপজেলার উজানটিয়া করিমদাদ মিয়া ঘাট থেকে রোহিঙ্গাদের উদ্ধার ও পাচারকারীদের আটক করা হয়। কোস্ট গার্ডের টেকনাফ স্টেশনের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এম ফয়জুল ইসলাম জানান, আটক দালালরা হচ্ছেন পেকুয়ার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ টিটু, আবদুল গনি, মোহাম্মদ মনসুর ও মোহাম্মদ মেজবাহ। সেন্টমার্টিনের দক্ষিণ বিচ এলাকায় অভিযান চালিয়ে পাঁচ মানব পাচারকারীকে আটক এবং ১৭ জন রোহিঙ্গা সদস্যকে উদ্ধার করা হয়। তাদের মধ্যে শিশুসহ ১০ জন পুরুষ ও সাতজন নারী রয়েছেন। এ ছাড়া অন্য ৬৭ জনকে আটক করা হয়েছে পেকুয়ার উজানটিয়া করিমদাদ মিয়াঘাট থেকে। তাদের মধ্যে ২১ জন পুরুষ, ৩১ জন নারী ও ১৫ জন শিশু রয়েছে।
টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস জানান, পাচারকারীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। রোহিঙ্গা সদস্যদের আদালতে উপস্থিত করে তাদের নিজ নিজ ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে।
পেকুয়া থানার ওসি জাকির হোসেন ভূঁইয়া বলেন, রোহিঙ্গারা জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, তারা সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য জড়ো হয়েছিলেন। তারা পাচার কাজে জড়িত বাংলাদেশি চার দালালের নামও পুলিশের কাছে প্রকাশ করেন। দালালদের আটকের চেষ্টা চলছে।

Others শীর্ষ সংবাদ