তাজুল : রাজনীতি মানেই দুর্নীতি—তৃতীয় পর্ব দখলবাজিতে বেপরোয়া স্ত্রী ফৌজিয়া

তাজুল : রাজনীতি মানেই দুর্নীতি—তৃতীয় পর্ব দখলবাজিতে বেপরোয়া স্ত্রী ফৌজিয়া

বিশেষ প্রতিনিধি

পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের ক্ষমতার দাপটে তাঁর স্ত্রী ফৌজিয়া ইসলামও অবৈধ দখলে মেতেছিলেন। তাতে তিনি ছিলেন ‘বেপরোয়া’। স্বামীর দানবীয় ক্ষমতার শক্তিতে পিছিয়ে ছিলেন না মন্ত্রীপত্নী ফৌজিয়া। সম্পদ অর্জনে ক্ষমতাধর স্বামীর সঙ্গে যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন তিনি।

তাজুল ইসলাম রাস্তাঘাট, পুল, কালভার্ট থেকে যখন অবৈধ কমিশনের হাজার হাজার কোটি টাকার হিসাব কষেন, তখন স্ত্রী ফৌজিয়া খামারের শখ পূরণ করতে মেতে ওঠেন বান্দরবানে পাহাড় দখলে। স্বামীর ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে এক হাত কেনেন তো ১০ হাত দখল করেন। অসহায় পাহাড়ি পরিবারের শত শত একর জমিতে চোখ পড়ে ফৌজিয়ার। ফৌজিয়ার লোভে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন পাহাড়ে জমির মূল মালিকরা।

এ নিয়ে পাহাড়ি জমির মালিকরা মামলা করেছেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। উল্টো অভিযোগকারীদেরই এলাকা ছাড়া করেন ফৌজিয়া। তাজুল ও ফৌজিয়ার বিচারের দাবিতে অবশ্য ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়িরা মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে।

বান্দরবানের ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়িরা মানববন্ধনে তাদের জায়গা-জমি, চলাচলের রাস্তা জোরপূর্বক দখলের প্রতিবাদ জানায়। দখলীয় জায়গা পুনরুদ্ধার করে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিও দাবি করে। বান্দরবান প্রেস ক্লাবের সামনে দেরাজ মিয়াপাড়া, ফুইট্টা ঝিরি, টংগঝিরি, পুর্গা খোলার শতাধিক পাহাড়ি বাঙালি নারী-পুরুষ মানববন্ধনে এসে এ দাবি জানিয়েছিল। তারা বলেছিল, বহিরাগত সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী ফৌজিয়া ইসলাম বর্তমানে আত্মগোপনে থেকে তাঁদের স্বজন শাহ আলম মুকুলের মাধ্যমে স্থানীয় সন্ত্রাসী মহাকাত আলী, শাহাব উদ্দিন, বাবুল, বেদু, দেলুয়ার, লিয়াকত, সোহরাব, রায়হান, শাহেব মিয়াসহ কয়েকজনকে দিয়ে ঘরবাড়ি ভাঙচুর করেছে ও জায়গা থেকে সরে না গেলে প্রতিনিয়ত হত্যার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন সময় মামলা দেওয়ার পরও এসব সন্ত্রাসী প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

কিন্তু পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করছে না। তারা তাজুল ইসলাম, স্ত্রী ফৌজিয়া ইসলাম ও তাঁর স্বজন শাহ আলম মুকুলসহ সব সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তারের দাবি জানায়। তাদের দাবি, অভিযুক্তরা লামার সরইয়ের দেরাজ মিয়াপাড়ায় ভুয়া কাগজ তৈরির মাধ্যমে অসহায় পরিবারের ৫০০ একরের বেশি জমি বেদখল করেছেন। তাই অতিসত্বর এসব জায়গা উদ্ধার করে অসহায় পরিবাগুলোকে ফিরিয়ে দিয়ে দোষীদের শাস্তির দাবি জানায় তারা। গত বছরের ৫ আগস্ট বাধ্য হয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। তারপর থেকে আত্মগোপনে আছেন তাজুলও।
বান্দরবানের লামার সরই ইউনিয়নের আন্দারীর ফুইট্টার ঝিরির পাহাড়ি-বাঙালিসহ প্রায় ১০০ পরিবারকে ‘সন্ত্রাসী বাহিনী’ দিয়ে নিজ জমিতে কাজ করতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে। ফুইট্টা ঝিরির বাসিন্দারা অভিযোগ করে, পাড়াবাসী ফুইট্টা ঝিরির নিজ জমিতে কাজ করতে গেলে হঠাৎ তাজুলের ম্যানেজারসহ একদল লোক দা ও লাঠি নিয়ে হামলা করতে আসে। এ সময় তাদের ভয়ে পাড়াবাসী নিজেদের জায়গা থেকে পালিয়ে যায়। তাজুল ইসলাম লামার সরইতে নিয়মবহির্ভূতভাবে দলিলে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে জোর করে দখলে নিয়েছেন প্রায় কয়েক শ কোটি টাকার জমি। জমিগুলোও সরকারিভাবে জব্দ করার দাবি জানায় তারা।

স্থানীয় বাসিন্দারা দুর্নীতি দমন কমিশন—দুদকে অভিযোগ করেছে, বান্দরবানের স্থানীয় বাসিন্দা না হলে কেউ জায়গা কিনতে পারেন না। তাহলে তাজুল ও তাঁর স্ত্রী ফৌজিয়া কিভাবে জায়গা কিনলেন? পাহাড়ের লোকেরা বান্দরবানে থেকেও জমি ইজারা পায় না। বাহির থেকে এসে তাজুল ইজারা নেন কিভাবে? সরকার পতনের পর তাজুল পালিয়ে গেলেও তাঁর সন্ত্রাসী বাহিনী স্থানীয়দের ওপর হামলা চালিয়ে জমি দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করছে ভুক্তভোগীরা।

ভুক্তভোগীদের একজন মতিলাল ত্রিপুরা বলেন, ‘আমাদের ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে জুম চাষের জমিগুলো তাজুল ইসলাম, তার স্ত্রী ফৌজিয়া ইসলাম ও তাদের স্বজন শাহ আলম মুকুল মিলে দখল করেছে। আমরা আমাদের নিজ জমিতে কাজ করতে গেলে সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে হুমকি দিচ্ছে। এখন আমরা জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে ভয়ে আছি।’ জানা গেছে, বান্দরবানের লামার সরইতে তাজুল ইসলামের স্ত্রী ফৌজিয়া ইসলামসহ তাঁর স্বজনরা ৫০০ একরের বেশি জমি দখল করেছে। ভুক্তভোগীরা বলে, ফৌজিয়া ছিলেন দানবী, তাঁর লোভে বহু অসহায় পরিবার নিঃস্ব হয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাজুল ইসলামের স্ত্রী ফৌজিয়ার অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য পায় দুদক। সংস্থাটির প্রাথমিক তদন্তে বের হয়েছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। ফৌজিয়া ইসলামের ৩০৪.৫৯ একর জমি, ঢাকা ও চট্টগ্রামে ফ্ল্যাট ক্রোক, ব্যাংক হিসাব ও শেয়ার অবরুদ্ধের আদেশ দিয়েছেন আদালত। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৫ এপ্রিল ঢাকার মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজ জাকির হোসেন গালিবের আদালত এ আদেশ দেন। অবরুদ্ধের আদেশ দেওয়া অস্থাবর সম্পদের তালিকায় রয়েছে ১২টি ব্যাংক হিসাব ও ১৪টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার। ব্যাংক হিসাবে আছে এক কোটি ৪২ লাখ ৬৪ হাজার ১৩৫ টাকা। আর ১৪টি প্রতিষ্ঠানে থাকা শেয়ারের মূল্য তিন কোটি ১৯ লাখ ১২ হাজার ৪৮০ টাকা। এসব অস্থাবর সম্পদের মোট মূল্য চার কোটি ৬১ লাখ ৭৭ হাজার ২১৫ টাকা। স্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে ঢাকার গুলশানে জমিসহ একটি ফ্ল্যাট, চট্টগ্রামের হালিশহরে চারতলা পাকা বাড়ির এক-তৃতীয়াংশ। এ ছাড়া বান্দরবানের লামা উপজেলায় ইজারা ও বায়না দলিলমূলে ৫৩ দলিলে প্রায় ৩০৪.৫৯ একর জমি।

দুদকের আবেদনে বলা হয়, ফৌজিয়া ইসলামের বিরুদ্ধে অসাধু উপায়ে জ্ঞাত আয়ের উৎসর সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ ছয় কোটি ৯০ লাখ দুই হাজার চার টাকার সম্পদের মালিকানা অর্জন ও দখলে রাখা এবং তাঁর স্বামী মো. তাজুল ইসলাম কর্তৃক অসদুপায়ে উপার্জিত অর্থ দ্বারা স্ত্রীর নামে বর্ণিত ছয় কোটি ৯০ লাখ দুই হাজার চার টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনে সহায়তা প্রদান এবং ১১টি ব্যাংক হিসাবে সন্দেহজনক ১৩ কোটি ৯৩ লাখ ৫০ হাজার ২০৩ টাকা জমা এবং ১৩ কোটি ১৮ লাখ ৪৪ হাজার ৯৭৫ টাকা উত্তোলন করা হয়। সর্বমোট ২৭ কোটি ১১ লাখ ৯৫ হাজার ১৭৮ টাকা হস্তান্তর, রূপান্তর ও স্থানান্তরপূর্বক আয়ের উৎস আড়াল করে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ২৭(১) ধারা এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারাসহ পেনাল কোডের ১০৯ ধারায় একটি মামলা রুজু করা হয়।

গত ১৩ এপ্রিল সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের (৬৯) নামে থাকা ঢাকা, কুমিল্লা ও নারায়ণগঞ্জের ২৮.৬৩ বিঘা জমি, কুমিল্লার বিভিন্ন জায়গায় থাকা দুটি বাণিজ্যিক স্পেস, একটি ফ্ল্যাট ও একটি দোকান জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া তাঁর নিজ ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা ৫০টি ব্যাংক হিসাব ও শেয়ারে জমা ২৮ কোটি টাকা অবরুদ্ধের আদেশ দেন আদালত।

জাতীয় শীর্ষ সংবাদ