বিশেষ সংবাদদাতা
মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের অন্যতম বৃহৎ আবাসস্থল মোহাম্মদপুর এলাকা। এখানে শতাধিক স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসা আছে। তবে এলাকাটি শিক্ষার প্রসারের জন্য আলোচনায় আসে না। ছিনতাই, ডাকাতি, খুনোখুনি, মাদকসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে মোহাম্মদপুর আলোচিত হচ্ছে বারবার।
ঢাকা মহানগর পুলিশ-ডিএমপির অপরাধ তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত তিন মাসে ৪৫টি ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে মোহাম্মদপুর থানায়। ছয় মাসে ডাকাতি ও ডাকাতির চেষ্টায় মামলা হয়েছে ২৩টি। একই সময়ে (জানুয়ারি-জুন) চাঁদাবাজীর মামলা হয়েছে ১৯টি। ৯ মাসে হত্যা মামলা হয়েছে ১৭টি। চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় সাত মাসে গ্রেপ্তারও উল্লেখযোগ্য– ৩৭৯ জন। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বাগে আসছে না।
এমন বাস্তবতায় গতকাল রাস্তায় নেমেছেন সেখানকার ৭০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শত শত শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক। তারা অপরাধমুক্ত, নিরাপদ মোহাম্মদপুর চেয়ে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছেন। অভিভাবকরা ভোরে ও সন্ধ্যায় সন্তানদের নিয়ে স্কুলে যেতেও আতঙ্কে ভুগছেন।
গতকালের মানববন্ধনের আয়োজক আলফা স্টার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মো. কামরুল হাসান সমকালকে বলেন, নিরাপত্তাহীনতার কারণে অনেক বাসিন্দা মোহাম্মদপুর ছেড়ে যাচ্ছেন। এখানে সবচেয়ে আতঙ্ক কিশোর গ্যাং ও ছিনতাইকারী। যখন-তখন চাপাতি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এরা। বিশেষ করে ভোরে ও রাতে বেশি আতঙ্কে থাকে মানুষ।
২৫ জুন মোহাম্মদপুরের নবোদয় হাউজিংয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ এলাকার খালপাড়ের সড়কে ছিনতাইয়ের একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তাতে দেখা যায়, চাপাতি হাতে তিন তরুণ হেঁটে এসে একটি রিকশার পথরোধ করে। কোপানোর ভয় দেখিয়ে কেড়ে নেয় আরোহীর সঙ্গে থাকা সব সামগ্রী। রাত ১০টা ৪০ মিনিটে ওই ঘটনার সময় রাস্তায় আরও লোকজন, যানবাহন থাকলেও ছিনতাইকারীরা ছিল বেপরোয়া। এর মাসখানেক আগে একই স্থানে দিনের বেলায় ছিনতাইয়ের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। ওই এলাকায় ছিনতাই, ডাকাতি, এমনকি হত্যাকাণ্ডের কয়েকটি ঘটনার ভিডিও বা সিসিটিভি ফুটেজ দেখে বারবার আঁৎকে ওঠে মানুষ।
এই এলাকায় পুলিশ-র্যাবের পাশাপাশি সেনাবাহিনীও বিশেষ অভিযান পরিচালনা করেছে। অভিযানে গোলাগুলিতে দুজন মারাও গেছে। ছিনতাই-ডাকাতিতে জড়িত অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়। এতে সাময়িক স্বস্তি এলেও এখনও যেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরেই রয়ে গেছে এলাকাটি।
কয়েক দিন আগে ছিনতাইয়ের একটি ঘটনার প্রতিকার চাইতে থানায় গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েন এক সাংবাদিক। ছিনতাইয়ের শিকার সাংবাদিকের শার্টের একটি বোতাম খোলা কেন– তা নিয়ে জেরা করেন ডিউটি অফিসার। পরে ভুক্তভোগী ওসির কাছে গেলে তিনি ঘটনা শুনে বলেন, ‘ওসি হয়ে আমি এই কম দামি ফোন ব্যবহার করি, …দামি ফোন নিয়ে ঘুরলে ছিনতাই তো হবেই।’ ভুক্তভোগী এ ঘটনা ফেসবুকে পোস্ট করলে অপরাধ দমনে পুলিশের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সমালোচনার মুখে পুলিশ দ্রুত তাঁর লুণ্ঠিত মোবাইল ফোন উদ্ধার এবং জড়িত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে।
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার ইবনে মিজান সমকালকে বলেন, এই এলাকায় ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চলছে। এলাকাবাসীকে নিরাপত্তা দেওয়ার পাশাপাশি তাদের মধ্যে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে নানামুখী তৎপরতা চলছে। মোহাম্মদপুর-আদাবরের অপরাধপ্রবণ স্পট ঘিরে প্রতিদিন স্থান বদল করে চেকপোস্ট বসানো হচ্ছে। দিনে ১০টি ও রাতে ১০টি টহল দল কাজ করছে। এর সঙ্গে রয়েছে প্রতিটি থানার তিন-চারটি মোটরসাইকেল টহল। অপরাধীদের বাসস্থান ঘিরে ব্লকরেইড দেওয়া হচ্ছে।
এ কর্মকর্তা বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আজকের (গতকাল) কর্মসূচি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সবাইকে আরও সচেতন করতে ভূমিকা রাখবে।
আলফা স্টার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মো. কামরুল হাসান বলেন, এ কর্মসূচির মধ্যম্যে আমরা জানাতে চেয়েছি– এলাকার শান্তিশৃঙ্খলা ফেরাতে প্রশাসনের সঙ্গে আমরা আছি। ছোট্ট এই এলাকায় পাঁচটি সরকারি কলেজ, পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক নামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। প্রায় ১৮ লাখ লোকের এই জনপদে সবাইকে নিয়ে পুরোপুরি শান্তিশৃঙ্খলা ফেরাতে হবে।
আছে চাঁদাবাজিও
ডিএমপির অপরাধ পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, মোহাম্মদপুর থানায় চাঁদাবাজির ঘটনায় গত ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) ১৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে মার্চ মাসে হয়েছে ১০টি মামলা। এসব মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছে ২৯ জন। এর মধ্যে মার্চে ১৭ এবং মে মাসে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া গত বছরের শেষ চার মাসে আটটি চাঁদাবাজির ঘটনায় মামলা হয় মোহাম্মদপুর থানায়। তবে প্রকৃত ঘটনা অনেক বেশি বলে জানান স্থানীয়রা।
র্যাব-২ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ খালিদুল হক হাওলাদার সমকালকে বলেন, র্যাব-২ এর নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় সন্ত্রাসী ও কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত সাড়ে ৭০০ অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিশেষ করে মোহাম্মদপুরকেন্দ্রিক কিশোর গ্যাং ও সন্ত্রাসীদের আর মাথাচাড়া দেওয়ার সুযোগ নেই। ২০টি কিশোর গ্যাং এবং জেনেভা ক্যাম্পের দুটি সন্ত্রাসী গ্রুপকে দমন করা হয়েছে।
একের পর এক খুন
গত ২৬ জুলাই মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজারে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের মূল ফটক এলাকায় দিনদুপুরে ফজলে রাব্বী সুমন নামে এক যুবককে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। মোবাইল ফোন ছিনতাইয়ে বাধা দিলে এ ঘটনা ঘটে।
সুমন হত্যার ১০ দিন আগে ১৬ জুলাই এক ঘণ্টার ব্যবধানে মোহাম্মদপুর ও আদাবরে দুজনকে হত্যা করা হয়। সেদিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যান সড়কের লাউতলায় আল-আমিন নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এর পর নবোদয় হাউজিং এলাকায় বাসার সামনে মো. ইব্রাহিম নামে একজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
এর আগে ১৬ মে রাতে মোহাম্মদপুরের দুর্গামন্দির গলিতে ছিনতাইকারীর হাতে প্রাণ হারান পেশাদার আলোকচিত্রী নূর ইসলাম। তিনি বিয়ে, জন্মদিনসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ভিডিও ধারণ ও ছবি তুলতেন। ক্যামেরা ছিনিয়ে নিতেই তাঁকে হত্যা করা হয় বলে পরে জানিয়েছিল পুলিশ।
একই রাতে মোহাম্মদপুরের অদূরে জিগাতলা এলাকায় মো. আলভী নামে এক কলেজছাত্র ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারান। এর আগের দিন মোহাম্মদপুরের সিটি হাউজিং এলাকায় রাকিব হোসেন নামে এক যুবককে ছিনতাইকারী সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
৩০ জুন মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডে দুর্বৃত্তদের হামলায় স্থানীয় বিএনপি নেতা মো. মিন্টু গুরুতর আহত হন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরদিন ভোরে তাঁর মৃত্যু হয়।
আধিপত্য বিস্তার নিয়ে গত এক বছরে মোহাম্মদপুরের মাদক স্পট জেনেভা ক্যাম্পে ছয়জন মাদক কারবারিদের গুলি বা ধারালো অস্ত্রের আঘাতে প্রাণ হারান। তারা হলেন– শাহেনশাহ, কালু, সনু, সজ্জন, সাগর ও রাজ।
অপ্রতিরোধ্য ছিনতাই
মামলার হিসাবের বাইরে এমন দিন খুঁজে পাওয়া মুশকিল, যেদিন এই এলাকায় ছেট-বড় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে না। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল, মে ও জুন মাসে মোহাম্মদপুরে অন্তত ৪৫টি ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা হয়েছে। এ সময়ে চুরির মামলা হয় ২০টি। খুনের ঘটনা তিনটি। বাস্তবে চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা আরও অনেক বেশি ঘটে। তবে বেশির ভাগ ভুক্তভোগী পুলিশি ঝামেলা এড়াতে থানায় যান না। ফলে তাদের ঘটনার রেকর্ড পুলিশের খাতায় থাকে না। শুধু আলোচিত ঘটনাগুলোই সবার নজরে আসে, মামলা হয়।
মোহাম্মদপুরে আয়শা গ্রুপ ও পানি রুবেল গ্যাং নামে দুটি আলোচিত ছিনতাইকারী চক্র রয়েছে বলে জানায় পুলিশ। এর মধ্যে আয়শা গ্রুপ কবজি কাটা আনোয়ারের মদদপুষ্ট। একাধিক সিসিটিভি ফুটেজে তাদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ড ধরা পড়ে।
আয়শা গ্রুপের প্রধান আসাদ ওরফে আরশাদ ওরফে আয়শা ও তার সহযোগীরা আদাবর এলাকায় এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে জখম করে। সেই ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ ভাইরাল হয়। পরে আসাদ ও তার সহযোগী ইউসুফকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। সম্প্রতি সিটিটিসি পানি রুবেল গ্যাংয়ের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে।
জুনের শেষ দিকে এবং ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে মোহাম্মদপুরে যথাক্রমে এক যুবক ও রিকশা আরোহী এক নারীর ছিনতাইয়ের শিকার হওয়ার ভিডিও ভাইরাল হয়।