নিজস্ব প্রতিবেদক,
গত বছর ১ জুলাই শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলন সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে রূপ নেয় ৩ আগস্ট। ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের ডাকা ‘সর্বাত্মক অসহযোগে’ নজিরবিহীন সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। ক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীরা তাঁদের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি এক দিন এগিয়ে এনে ৫ আগস্ট নির্ধারণ করে। আর এতেই যেন ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে যায় বিগত সরকার ও সরকারপ্রধানের।
পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
হাসিনা সরকারের পতন ছাত্র-জনতার বিজয়৫ আগস্ট তড়িঘড়ি করে পদত্যাগের পর দুপুর আড়াইটার দিকে একটি সামরিক বিমানে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। সঙ্গে ছিলেন ছোট বোন শেখ রেহানা। তাঁদের বহনকারী সামরিক বিমানটি যখন ভারতের উদ্দেশে ছেড়ে যায়, তখন পেছনে পড়ে থাকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে ব্যাপক সংঘাত-সহিংসতা, লাশের স্তূপ আর নিপীড়িতের হাহাকার।
জুলাইয়ের শেষ ভাগে এসে আন্দোলনকারীরা জানান, তাঁদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত জুলাই মাস চলতেই থাকবে। ফলে ৫ আগস্ট হয়ে যায় ‘৩৬ জুলাই’। সেই ৩৬ জুলাইয়ে রচিত হয় ছাত্র-জনতার এক ঐতিহাসিক বিজয়গাথা। গণপ্রতিরোধে ভেসে যায় স্বৈরশাসন ও দম্ভ।
এর আগে সরকার পতনের এক দফা দাবিতে ডাকা ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ বা ঢাকামুখী গণযাত্রা সফল করতে কারফিউ অমান্য করে রাজধানীর রাস্তায় নেমে আসে লাখো মানুষ। ঢাকার বিভিন্ন প্রবেশপথ দিয়ে মানুষ আসতে থাকে। সকাল ১০টার পর থেকে যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, শহীদ মিনার, বাড্ডা, মিরপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভকারীদের জমায়েতের খবর আসতে শুরু করে। রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী অবস্থান নিলেও রোধ করা যায়নি ঢাকামুখী জনস্রোত। কোথাও কোথাও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষও হয়।
দুপুর নাগাদ অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে যায়, নড়ে যাচ্ছে সরকার। দুপুর সোয়া ১টার দিকে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জনগণের উদ্দেশে বক্তব্য দেবেন। তখনই মানুষ বুঝে যায়, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। ঘর থেকে বের হতে শুরু করে মানুষ। শেখ হাসিনার পদত্যাগের কথা জানাজানি হয়ে যায়। রাজপথ ভরে ওঠে লাখো জনতায়। রাজধানীসহ সারা দেশের মানুষ বিজয় উল্লাসে মেতে ওঠে। একপর্যায়ে বিকেলের দিকে জনস্রোত গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও জাতীয় সংসদ ভবনে ঢুকে পড়ে। বিজয়োল্লাসের পাশাপাশি এসব জায়গায় ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনাও ঘটে।
এমন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনার পর বিকেলে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তিনি বলেন, ‘দেশে একটা ক্রান্তিকাল চলছে। সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের আমন্ত্রণ করেছিলাম। আলোচনায় আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে। আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি, সব হত্যা, সব অন্যায়ের বিচার আমরা করব। আপনারা সেনাবাহিনীর প্রতি, সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি আস্থা রাখুন।’
সেনাপ্রধানের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান, হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকিসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
পরে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সভাপতিত্বে বঙ্গভবনে সিদ্ধান্ত হয়, অনতিবিলম্বে দেশে একটি ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে। বৈঠকে সেনাপ্রধান, নৌপ্রধান ও বিমানবাহিনীর প্রধান এবং দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা ছিলেন। সভায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহতদের স্মরণে শোক প্রস্তাব গৃহীত হয়। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সবাইকে ধৈর্য ও সহনশীল আচরণ করার আহবান জানানো হয়। এ ছাড়া সভায় সর্বসম্মতিক্রমে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে বিভিন্ন মামলায় আটকদের মুক্তির ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত হয়।
এদিন রাত সোয়া ৯টায় একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জাতীয় সরকারের রূপরেখা দেওয়া হবে। ছাত্রজনতা, নাগরিকসমাজের প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের একটি রূপরেখা জাতির সামনে উপস্থান করা হবে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, দেশের সর্বস্তরের জনগণ ও দলের নেতাকর্মীদের শান্ত থাকার আহবান জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
কয়েক ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট এবং এক দিন বন্ধ থাকার পর এদিন দুপুর ১টার পর দেশে আবারও মোবাইল ইন্টারনেট চালু হয়। রাতে আইএসপিআর (আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, পরের দিন ৬ আগস্ট ভোর ৬টার পর কারফিউ থাকবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান ও কারখানা খোলা থাকবে।
এক দিনে আবারও শত মৃত্যু, নজিরবিহীন হামলা ও লুটপাট : ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে এদিন দুপুরে আন্দোলনকারীরা অবস্থান করছিলেন রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায়। অভিযোগ রয়েছে, একপর্যায়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে শুরু করে। এতে নিহত হন অনেকে। অন্যদিকে সরকার পতনের পর যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের মালিকানাধীন হোটেল দ্য জাবির যশোরে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এতে দগ্ধ হয়ে অন্তত ১৩ জন নিহত ও ২০ জন গুরুতর আহত হয়। সে সময়ের গণমাধ্যমগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় এদিনের সংঘর্ষ, সহিংসতা ও গুলিতে অন্তত ১০৯ জন নিহত হয়। আহত হয় অনেকে। আগের দিন ৪ আগস্টও সংঘর্ষে ১১৪ জনের মৃত্যু হয়। এদিন প্রধান বিচারপতির বাসভবন, পুলিশ সদর দপ্তর, শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত বাসভবন সুধা সদনসহ রাজধানীতে বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। সারা দেশে আওয়ামী লীগের কার্যালয়, সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও নেতাদের বাসভবন ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও হামলার ঘটনা ঘটে। সরকারের পদত্যাগের পর রাজধানীর ধানমণ্ডিতে ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু ভবন ও স্মৃতি জাদুঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালানো হয়।
৫ আগস্ট রাত ১০টা পর্যন্ত দেশের অন্তত ৪৪ জেলায় হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে পরদিন খবর প্রকাশ করে গণমাধ্যমগুলো। এর মধ্যে পতিত সরকারের ৯ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবং অন্তত ২৭ জন সংসদ সদস্যের বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।