গণঅভ্যুত্থানে সামাজিক মাধ্যমের ভূমিকা

গণঅভ্যুত্থানে সামাজিক মাধ্যমের ভূমিকা

সাইদুর রহমান

এক অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান ঘটল বাংলাদেশে। এ ফলশ্রুতিতে, জেঁকে বসা স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারের পতন ঘটে। ভারতে পালাতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। এ অভ্যুত্থানে ভূমিকা রেখেছে ছাত্র-জনতা, রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন সংগঠন, গোষ্ঠী ও ব্যক্তি। এর বাইরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো এ গণঅভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন তুঙ্গে, চারিদিকে ভয়-আতঙ্ক আর লাশের মিছিল, আন্দোলন দানা বেঁধেই চলেছে, কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না, তখন সরকারের সজাগ দৃষ্টি গণমাধ্যমগুলোর ওপর। যেন সরকারবিরোধী কোনো তথ্য প্রচার করতে না পারে। এ সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো, বিশেষ করে ফেসবুক হয়ে ওঠে তথ্য আদান-প্রদানের এক অন্যান্য মাধ্যম।

জুলাই-আগস্টের অতীত স্মৃতিতে ফিরলে দেখা যাবে, আওয়ামী সমর্থক ও তাদের পেটুয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্বিচারে গুলি করে মানুষ হত্যা করছে। দলীয় ক্যাডারও শটগান দিয়ে গুলি করছে। দেশীয় অস্ত্র দিয়ে কোপাচ্ছে। এসব তথ্য বা চিত্রগুলো যতটা না গণমাধ্যমে পাওয়া যেত, তারচেয়ে বেশি ঘুরত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে নাড়া দেয় প্রবাসীদের হৃদয়েও। ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ও দমন-পীড়নের প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে আফ্রিকার প্রান্তিক শহর পর্যন্ত। আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নিলে সরকার দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। এতে ক্ষুব্ধ প্রবাসীরা ঘোষণা দেন বৈধপথে রেমিট্যান্স না পাঠানোর। এ ঘোষণায় সমর্থন দেন অনেকে। বেড়ে যায় আন্দোলনের গতি। জুলাই মাসে সে বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন রেমিট্যান্স আসে দেশে। অনেক প্রবাসী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ জন্য নিয়মিত জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।

এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো আন্দোলনের তথ্যগুলো ব্যাপকভাবে প্রচার, সাধারণ মানুষের মধ্যে জনমত গড়ে তোলা, জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি ও আন্দোলনের কর্মীদের মধ্যে দ্রুত যোগাযোগ স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এ মাধ্যমটি। সরকারের ভয়ে যখন আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিরা আত্মগোপনে ছিলেন, তখন ভরসা ছিল ইন্টারনেট দুনিয়ার ওপরেই। যে কোনো স্থানে বসে আন্দোলনের ডাক দেওয়া বা কর্মসূচি ঘোষণার জন্য এটি একটি কার্যকর মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে আন্দোলনের সময়কার ঘটনার ছবি, ভিডিও এবং তথ্যচিত্র শেয়ার করে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো হয়েছে। তবে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে। এ মাধ্যমে তথ্যের অবাধ প্রবাহ থাকার ফলে এবং তা সঠিকভাবে এসচেক করার সুযোগ না থাকায় অপতথ্য ও গুজব ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে।

দেশে হত্যাযজ্ঞের মধ্যে যখন সরকারের তিন মন্ত্রীর সঙ্গে ছাত্র আন্দোলনের সামনের সারির তিন সমন্বয়ক বৈঠক করে আট দফা দাবি জানান, তখন অন্য সমন্বয়করা তা প্রত্যাখ্যান করেন। প্রত্যাখ্যান করে তারা ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ছাত্র হত্যার দায় নিয়ে জাতির কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে’সহ ৯ দফার ঘোষণা দেন। কিন্তু, শুরুতে এ ৯ দফা দৈনিক ইত্তেফাক, মানবজমিন, আজকের পত্রিকা ও প্রথম আলো ছাড়া আর কেউ প্রচার করেনি। যমুনাসহ কোনো টেলিভিশনও ৯ দফা প্রচার করেনি। অন্যদিকে দেশের ইন্টারনেট সেবা তখন বন্ধ। মোবাইল নেটওয়ার্কও ভীষণ দুর্বল। কল যেত না বললেই চলে। এক লাইনের ছোট ছোট মেসেজ করা যেত। বড় মেসেজ করা যেত না। মানে, বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। এটা ছিল সরকারের কারসাজি। যেন, মোবাইলের মেসেজের মাধ্যমেও কেউ কোনো বড় ইনফরমেশন ছড়িয়ে দিতে না পারে। তখন দেশের বাইরে অবস্থান করা মানুষের কাছে ঐ ৯ দফা পাঠানো হয়, যেন তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করতে পারেন। দেশের ভেতরে যাদের অন্য সিস্টেমে ইন্টারনেট চালানোর সুযোগ ছিল, তাদের কাছে পাঠানো হয়। এ কাজে যুক্ত ছিলেন অনেকে। কেউ কেউ হাজারেরও বেশি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বার্তার মাধ্যমে এসব তথ্য পৌঁছাতে কাজ করেছিল। সেগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করেন অনেকে। কেউ কেউ তথ্য জেনে অন্যকে জানান। পরবর্তী সময় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো এ ৯ দফা প্রচার করে।

ছাত্র-জনতার ওপর হত্যা ও নির্যাতনের বিচার না করে নির্মম উপহাস করছিল আওয়ামী লীগ। এমন অভিযোগ এনে ২০২৪ সালের ২৯ জুলাই রাষ্ট্রীয় শোক প্রত্যাখ্যান করে মুখে ও চোখে লাল কাপড় বেঁধে ছবি তোলার কর্মসূচির ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এ কর্মসূচিতে বাংলাদেশের আপামর মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ব্যাপকভাবে প্রচারে সবচেয়ে ভূমিকা রাখে সামাজিক মাধ্যমগুলো। ফেসবুকে আন্দোলনের সমর্থনে থাকা ব্যক্তিরা মুখে লাল কাপড় বেঁধে সরকারের উপহাসের প্রতিবাদ করেন। এতে আন্দোলনের তীব্রতা আরো বাড়ে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিরা লংমার্চ টু ঢাকার কর্মসূচি ঘোষণা করেন। পরবর্তী সময় যখন এ কর্মসূচি একদিন এগিয়ে আনা হয়, তখনো ফেসবুকে ভিডিওর মাধ্যমে এ ঘোষণা দেওয়া হয়। আন্দোলনের একেবারে শেষের দিকে কেউ কেউ ফেসবুকে পোস্ট করে আহ্বান জানাতেন, যেন ঘরে বসে না থেকে আন্দোলনের মাঠে সক্রিয় থাকা হয়। এমন আরো অনেক ঘটনা রয়েছে, যা প্রচারে সবচেয়ে ভূমিকা রেখেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমই। এক কথায় বলতে গেলে এভাবে বলা যায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো আন্দোলনকে অনেক সহজ করেছে, গতি এবং সম্পৃক্ততা বাড়িয়েছে। এক কথায় বলতে গেলে গণঅভ্যুত্থানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর ভূমিকা অনস্বীকার্য।

লেখক: সাংবাদিক

তথ্য প্রুযুক্তি শীর্ষ সংবাদ