ডা. আহাদ আদনান
ঘরে ঘরে জ্বর, সর্দি, কাশির প্রকোপ ক্রমেই বাড়ছে। শিশু থেকে মাঝ বয়সী, বয়স্ক–সবাইকে কাবু করছে এই জ্বর। তিন দিনেও তাপমাত্রা নামছে না অনেকের।
কেন হচ্ছে এত জ্বর?
ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ: ইনফ্লুয়েঞ্জা, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া–এমনকি করোনাভাইরাসও জ্বরের মূল কারণ হতে পারে।
ইনফ্লুয়েঞ্জা
ইনফ্লুয়েঞ্জা, যা সাধারণত ‘ফ্লু’ নামে পরিচিত, একটি সংক্রামক শ্বাসযন্ত্রের রোগ। এটি ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের কারণে হয় এবং এটি নাক, গলা এবং ফুসফুসকে আক্রান্ত করে।
লক্ষণ ও উপসর্গ: ফ্লুর লক্ষণগুলো সাধারণত হঠাৎ করেই দেখা দেয় এবং সর্দি বা সাধারণ ঠান্ডার চেয়ে বেশি তীব্র হয়। সাধারণ লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে:
lউচ্চ জ্বর (১০০° ফারেনহাইট বা ৩৮° সেলসিয়াসের বেশি) lগা ও পেশিতে ব্যথা
lমাথাব্যথা lক্লান্তি এবং দুর্বলতা lশুকনো কাশি lগলাব্যথা lনাক বন্ধ থাকা বা নাক দিয়ে পানি পড়া lশিশুদের ক্ষেত্রে বমি বা ডায়রিয়াও হতে পারে।
সংক্রমণ ও বিস্তার: ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস হাঁচি, কাশি বা কথা বলার সময় বাতাসে ছড়িয়ে পড়া ক্ষুদ্র জলকণার মাধ্যমে এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে ছড়ায়। এ ছাড়া ভাইরাসযুক্ত কোনো পৃষ্ঠ স্পর্শ করার পর যদি কেউ নিজের মুখ, চোখ বা নাক স্পর্শ করে, তাহলেও সংক্রমণ হতে পারে। এই ভাইরাস খুব দ্রুত ছড়ায়, বিশেষ করে বদ্ধ পরিবেশে। যেমন স্কুল, অফিস বা গণপরিবহনে।
প্রতিরোধ ও চিকিৎসা: ফ্লু প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো প্রতি বছর ফ্লু ভ্যাকসিন নেওয়া। এই ভ্যাকসিন ভাইরাসের বিভিন্ন স্ট্রেইন থেকে সুরক্ষা দেয়। এ ছাড়া কিছু সাধারণ সতর্কতাও নেওয়া যেতে পারে।
lনিয়মিত হাত ধোয়া
lঅসুস্থ ব্যক্তির থেকে দূরে থাকা
lহাঁচি বা কাশির সময় মুখ ও নাক ঢেকে রাখা
lশারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা
lঅসুস্থ হলে বাড়িতে থাকা এবং কর্মস্থলে বা স্কুলে না যাওয়া
ফ্লুর চিকিৎসা মূলত লক্ষণভিত্তিক। পর্যাপ্ত বিশ্রাম, প্রচুর পরিমাণে তরল পান করা এবং ব্যথানাশক ওষুধ গ্রহণ করে এর লক্ষণগুলো কমানো যায়।
ডেঙ্গু
ডেঙ্গু একটি মশাবাহিত ভাইরাল রোগ, যা ডেঙ্গু ভাইরাসের কারণে হয়। এটি ‘এডিস ইজিপ্টি’ নামক মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। এটি সাধারণত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এবং উপক্রান্তীয় অঞ্চলে দেখা যায় এবং এটি একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে বিবেচিত।
লক্ষণ ও উপসর্গ: ডেঙ্গু সংক্রমণের লক্ষণগুলো সাধারণত ২ থেকে ৭ দিনের মধ্যে দেখা দেয়। এর লক্ষণগুলো একটি সাধারণ ফ্লুর মতো হতে পারে। এ কারণে অনেক সময় রোগ নির্ণয় কঠিন হয়ে পড়ে।
এর সাধারণ লক্ষণগুলো হলো lহঠাৎ উচ্চ জ্বর (১০৪° ফারেনহাইট বা ৪০° সেলসিয়াস পর্যন্ত) lতীব্র মাথাব্যথা lচোখের পেছনে ব্যথা
lপেশি ও হাড়ের জয়েন্টে প্রচণ্ড ব্যথা (যা ‘হাড়ভাঙা জ্বর’ নামে পরিচিত) lত্বকে লাল র্যাশ
lক্লান্তি ও দুর্বলতা
lবমি বমি ভাব বা বমি
ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার এবং ডেঙ্গু শক সিনড্রোম কিছু ক্ষেত্রে ডেঙ্গু গুরুতর রূপ নিতে পারে, যা ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার বা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হিসেবে পরিচিত। এ অবস্থায় রক্তক্ষরণ, রক্তচাপ কমে যাওয়া এবং শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল হওয়ার মতো সমস্যা দেখা দেয়, যা জীবন-হুমকিস্বরূপ।
এর লক্ষণগুলো হলো–
lপেটে তীব্র ব্যথা l বারবার বমি l নাক বা দাঁতের মাড়ি থেকে রক্তপাত l কালো মল
l অত্যধিক ক্লান্তি ও অস্থিরতা
প্রতিরোধ ও চিকিৎসা: ডেঙ্গুর কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল চিকিৎসা নেই। এর চিকিৎসা লক্ষণভিত্তিক এবং এতে মূলত রোগীর স্থিতিশীলতা বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়। গুরুতর ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন হয়। ডেঙ্গু প্রতিরোধের সবচেয়ে ভালো উপায় হলো মশা নিয়ন্ত্রণ করা।
lমশার বংশবিস্তার রোধ করা, যেমন ফুলের টবে বা পাত্রে পানি জমতে না দেওয়া।
lমশারির নিচে ঘুমানো।
lমশা তাড়ানোর স্প্রে ব্যবহার করা।
l বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা।
চিকুনগুনিয়া
চিকুনগুনিয়াও একটি মশাবাহিত ভাইরাল রোগ। এটিও ‘এডিস ইজিপ্টি’ এবং ‘এডিস অ্যালবোপিকটাস’ মশার মাধ্যমে ছড়ায়। এর নামটি এসেছে তানজানিয়ার একটি ভাষা থেকে; যার অর্থ ‘যা বেঁকে যায়’। কারণ এই রোগে আক্রান্ত হলে তীব্র অস্থিসন্ধির ব্যথার কারণে মানুষ কুঁজো হয়ে হাঁটে।
লক্ষণ ও উপসর্গ:
চিকুনগুনিয়ার লক্ষণগুলো ডেঙ্গু জ্বরের মতোই, তবে কিছু নির্দিষ্ট পার্থক্য আছে:
lআক্রান্ত হওয়ার ৩ থেকে ৭ দিনের মধ্যে হঠাৎ জ্বর আসে।
lএতে সবচেয়ে প্রধান লক্ষণ হলো তীব্র অস্থিসন্ধির ব্যথা। এ ব্যথা এতটাই তীব্র হতে পারে যে রোগী হাঁটাচলা করতে পারে না।
lমাথাব্যথা, পেশি ব্যথা এবং ক্লান্তি।
lত্বকে লাল র্যাশ।
lচোখে ব্যথা এবং হালকা সর্দি বা কাশির মতো লক্ষণও থাকতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব: চিকুনগুনিয়ার প্রধান জটিলতা হলো দীর্ঘস্থায়ী অস্থিসন্ধির ব্যথা। জ্বর সেরে যাওয়ার পরও এই ব্যথা কয়েক সপ্তাহ, মাস বা এমনকি বছর ধরেও থাকতে পারে, যা রোগীর জীবনযাত্রার মানকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।
প্রতিরোধ ও চিকিৎসা: চিকুনগুনিয়ার কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। এর চিকিৎসাও লক্ষণভিত্তিক। ব্যথা কমানোর জন্য নন-স্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগস বা ব্যথানাশক ব্যবহার করা হয়। ডেঙ্গুর মতোই এটি প্রতিরোধের প্রধান উপায় হলো মশা নিয়ন্ত্রণ।
lমশার প্রজনন ক্ষেত্রগুলো ধ্বংস করা।
lমশারি ব্যবহার করা।
lমশা তাড়ানোর স্প্রে ও লোশন ব্যবহার করা।
lপুরো শরীর ঢেকে রাখে এমন পোশাক পরা।
[শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, ফয়সল হাসপাতাল,
আড়াইহাজার, নারায়ণগঞ্জ]