রাজধানীর মিরপুর-মতিঝিল রুটে চলাচল করে ট্রান্সসিলভা পরিবহনের সিটিং সার্ভিস বাসগুলো। ওঠার পর যাত্রী যেখানে খুশি নামতে পারেন, তবে এজন্য নূ্যনতম ভাড়া দিতে হয় ২০ টাকা। তবে শেষ গন্তব্য পর্যন্ত ভাড়া ৩০ টাকা। একই পথে চলাচলকারী অন্য পরিবহনের সিটিং সার্ভিস বাসগুলোর ক্ষেত্রেও একই নিয়ম চালু রয়েছে। ভাড়ার হারও অভিন্ন। তবে রোববার রাতে সিএনজির দাম বৃদ্ধির ঘোষণার পর সোমবার সকাল থেকে যাত্রীদের কাছ থেকে এসব বাসে নূ্যনতম ভাড়া আদায় করা হয়েছে ২৫ টাকা। মিরপুর-১ থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ভাড়া নেয়া হয়েছে ৩৫ টাকা। এ নিয়ে সকাল থেকে বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীদের সঙ্গে গণপরিবহনের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়, এমনকি ছোটখাটো হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে।
গণপরিবহন শ্রমিকদের দাবি, গ্যাসের দাম বাড়ায় জ্বালানি খরচ বেড়েছে। এ কারণে যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া নিতে হচ্ছে। মালিকের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিতে গাড়ি চালানোর কারণে বাড়তি ভাড়া না নিলে এ লোকসান তাদের বহন করতে হবে।
তবে গণপরিবহন যাত্রীদের অভিযোগ, গাড়ি ভাড়া বাড়ানোর ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তাই গণপরিবহন মালিক-শ্রমিকরা এখনই বাড়তি ভাড়া আদায় করতে পারেন না। অথচ প্রশাসনের নজরদারি না থাকায় এ নৈরাজ্য শুরু হয়েছে। এ পরিস্থিতি লাগাম দেয়া না গেলে পরিস্থিতি ভিন্ন রূপ নিতে পারে। এ নিয়ে যাত্রী ও গণপরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে বড় ধরনের সংঘর্ষ ঘটতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।
তবে সড়ক পরিবহন সূত্রগুলো জানায়, গ্যাসের দাম বাড়ার পর বাস-মিনিবাস ও অটোরিকশার ভাড়া বাড়বে কি না, বাড়লে কত বাড়বে, তা এখনো নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি। ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতিও ভাড়ার হার নির্ধারণের আগে বেশি ভাড়া না নিতে বাস কোম্পানির মালিকদের নির্দেশ দিয়েছে। ভাড়া নির্ধারণের আগেই বেশি ভাড়া আদায় করা হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
যদিও প্রশাসনের এ ধরনের হুমকি-ধমকিতে গণপরিবহনের ভাড়া নৈরাজ্যে কতটা লাগাম টানা সম্ভব হবে তা নিয়ে পরিবহন সংশ্লিষ্টরা সংশয় প্রকাশ করেছে। তাদের ভাষ্য, অতীতেও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির পর বাস-মিনিবাস ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার মালিক-চালকরা তাদের খেয়ালখুশিমতো ভাড়া বাড়িয়ে নিয়েছে। ওই সময়ও প্রশাসন নানা ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা দিয়ে তা নথিপত্রেই গন্ডি বদ্ধ রেখেছে।
এমনকি পরবর্তীতে গ্যাসের বর্ধিত মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ভাড়া বাড়ানো হলেও গণপরিবহন মালিক-শ্রমিকরা তা মানেনি। বরং তার চেয়ে তারা আরো এক ধাপ বেশি ভাড়া আদায় করেছে, যা পরবর্তীতে নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবারও আগের মতো একই ঘটনা ঘটবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন গণপরিবহন যাত্রীরা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, গণপরিবহনে ব্যবহৃত সিএনজি খাতে প্রতি ঘনমিটারে ৩ টাকা গ্যাসের দাম বাড়িয়ে ভাড়া নৈরাজ্য আরেক দফা উসকে দেয়া হয়েছে। নতুন করে গণপরিবহনের ভাড়া নির্ধারণের কোনো সিদ্ধান্ত না হলেও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে গণপরিবহনে বর্ধিত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য শুরু হয়েছে। এতে সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে নতুন করে ভাড়ার রেট নির্ধারণের আগে বর্ধিত ভাড়া নেয়া হবে না বলে বাস-ট্রাক মালিক সংগঠনের নেতারা দাবি করলেও শ্রমিকরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের ভাষ্য, বেশি দামে গ্যাস কিনে যাত্রীদের কাছ থেকে কেউ কম ভাড়া নেবে না। কবে সরকার বাড়তি ভাড়ার রেট নির্ধারিত করবে- এজন্যও কেউ বসে থাকবে না, সাফ জানান দেন তারা।
সিএনজি অটোরিকশা চালকরা জানান, গ্যাস কিনতে বাড়তি টাকা লাগছে। তাই যাত্রীদের কাছ থেকে তারা বাড়তি ভাড়া নিচ্ছে। কেউ পকেট থেকে টাকা গচ্চা দিয়ে যাত্রীসেবা করবে না- যোগ করেন তারা।
সোমবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত সায়েদাবাদ, কুড়িল বিশ্বরোড, মুগদা, রামপুরা, বাড্ডা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, শেওড়াপাড়া, মতিঝিল, কমলাপুর, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন রুটের অধিকাংশ গণপরিবহনে বাড়তি ভাড়া আদায় করতে দেখা গেছে। এছাড়া সিএনজি অটোরিকশা, ট্যাক্সিক্যাবেও চালকের ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করেছে।
সকাল পৌনে ৯টায় মালিবাগ মোড়ে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন ট্যাক্সিক্যাবের চালক জাহিদুল। এ সময় এক যাত্রী তার কাছে বিমানবন্দর যাওয়ার ভাড়া জানতে চাইলে তিনি ৭শ’ টাকা ভাড়া হাঁকেন। বেশি ভাড়া চাওয়ায় ওই যাত্রী উত্তেজিত হয়ে উঠলেও চালক জাহিদুলকে এ সময় অনেকটাই নির্বিকার দেখা গেছে। তার ভাষ্য, প্রতি ঘনমিটার গ্যাসে তিন টাকা বেশি নেয়া হচ্ছে। তাই বাড়তি খরচ হিসাব করেই তিনি একশ’ টাকা অতিরিক্ত ভাড়া চেয়েছেন। এতে যাত্রীদের ক্ষুব্ধ হওয়ার কিছু নেই বলে মন্তব্য করেন ট্যাক্সিক্যাব চালক জাহিদুল।
তবে হিসাব কষে দেখা গেছে, মালিবাগ মোড় থেকে বিমানবন্দর যেতে ১৫০০ সিসির একটি প্রাইভেট কারে সর্বোচ্চ ৫ ঘনমিটার গ্যাস লাগতে পারে। এতে গ্যাস বাবদ খরচ বাড়বে মাত্র ১৫ টাকা।
পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানান, শুধু ট্যাক্সিক্যাব কিংবা সিএনজি অটোরিকশাতেই নয়, বাস-মিনিবাস, টেম্পু-লেগুনাসহ সব গণপরিবহনেই গ্যাসের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে বাড়তি যে ভাড়া আদায় করার চেষ্টা করছে তা স্বাভাবিকের চেয়ে অন্তত ৫-৭ গুণ বেশি।
এ প্রসঙ্গে বাস মালিক সমিতির সভাপতি এনায়েত উল্যাহ সোমবার যায়যায়দিনকে বলেন, ঢাকায় কিছু সমস্যা আছে। তবে দূরপালস্নার বাসে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে না। সরকারিভাবে ভাড়া বাড়ানোর আগে কেউ যাত্রীর কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এদিকে সিএনজির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব ট্রাকের ভাড়াতেও পড়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন মোকাম থেকে রাজধানীতে চাল আনতে প্রতি কেজিতে ট্রাক ভাড়া দিতে হয় এক থেকে এক টাকা ২০ পয়সা। কিন্তু সিএনজির দাম বাড়ার কারণে সোমবার থেকে পরিবহন খরচও বেড়েছে। ট্রাক ব্যবসায়ীরা প্রতি কেজি চালের জন্য এখন ২০ পয়সা হারে বেশি ভাড়া চাচ্ছেন।
মোহাম্মদপুর কৃষিবাজারের পাইকারি চালের আড়তদার আহম্মেদ কবির জানান, সিএনজির দাম বাড়ানোর কারণে অবধারিতভাবেই ট্রাকের ভাড়া বাড়বে। এতে চালের দামও কিছুটা বাড়বে। তিনি জানান, সোমবার সকাল থেকেই ট্রাক ভাড়ায় এ প্রভাব পড়েছে। তবে তিনি এখনো বাড়তি ভাড়ায় চাল এনে খুচরা বাজারে সরবরাহ করেননি।
এদিকে সিএনজির দাম বাড়ার কারণে কাঁচামাল পরিবহন ব্যয়ও এরইমধ্যে বেশ কিছুটা বেড়েছে বলে দাবি করেন আড়তদাররা। তারা জানান, প্রতি রাতেই নরসিংদী, ময়মনসিংহ, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও উত্তরাঞ্চলের জেলাসহ দেশের নানা প্রান্ত থেকে শাকসবজি নিয়ে রাজধানীতে শত শত ট্রাক আসে। রোববার রাতে সিএনজির দাম বাড়ানোর ঘোষণার পর এই কাঁচামাল পরিবহনকারীরা ট্রাকের ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন। আর পচনশীল পণ্য হওয়ায় পাইকারি ব্যবসায়ীরা বাধ্য হয়েই বাড়তি ভাড়া গুনছেন, যা ক্রেতার কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে।
কারওয়ান বাজার কাঁচাবাজার আড়তদার সমিতির এক সদস্য জানান, উত্তরাঞ্চল থেকে আসা শাকসবজির প্রতিটি ট্রাকের ভাড়া দিতে হতো ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা, এখন তা বাড়িয়ে ১৬ থেকে ১৭ হাজার টাকা করা হয়েছে। আর নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ময়মনসিংহসহ রাজধানীর আশপাশের অঞ্চল থেকে প্রতি ট্রাকের ভাড়া ছিল সাত হাজার থেকে দশ হাজার টাকা। এখন দেড় থেকে দুই হাজার টাকা বাড়ানো হয়েছে।
তবে বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যায়যায়দিনকে বলেন, আন্তঃজেলা রুটে কিছু সংখ্যক বাস-ট্রাক গ্যাসে চলে। গ্যাসচালিত অধিকাংশ গাড়ি সিটি এলাকায় চলছে। যে কারণে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি পেলেও আন্তঃজেলা রুটে ভাড়ার কোনো পরিবর্তন আসার কথা না। অথচ সুযোগ বুঝে সবাই ভাড়া বাড়ানোর পাঁয়তারা করছে।
তবে অন্য এক নেতার দাবি, দূরপালস্নার বাস ছাড়াও জেলা সড়কগুলোতে সিএনজি ব্যবহার করে বাস-মাইক্রোবাস ও মিনিবাস চলে। এছাড়া প্রতিটি জেলায় হাজার হাজার লেগুনা, মিনি কাভার্ড ভ্যান শতভাগ গ্যাসে চলে। এসবের ভাড়া বেড়ে যাবে।
ওই নেতার ভাষ্য, আন্তঃজেলা ও দূরপালস্নার রুটে ৬০ শতাংশ গাড়ি সিএনজিতে চলে আর সিটিতে প্রায় ৯০ শতাংশ গাড়ি গ্যাসে চলছে। যে কারণে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পেলে সর্বস্তরের মানুষ ভোগান্তির মধ্যে পড়বেন। অন্যদিকে যে উদ্দেশ্যে ২০০১ ও ২০০২ সালে বায়ু দূষণমুক্ত পরিবেশের জন্য সিএনজির মাধ্যমে গাড়ি চালানো শুরু হয়েছিল, সেটি ব্যর্থ হবে। পরিবহন মালিকরা আবার ডিজেল দিয়ে গাড়ি চালানোতে ফিরে আসবে।