টিটিপি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে যুদ্ধবিরতি ভাঙার হুঁশিয়ারি পাকিস্তানের, সম্পর্কে টানাপোড়েন চরমে

টিটিপি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে যুদ্ধবিরতি ভাঙার হুঁশিয়ারি পাকিস্তানের, সম্পর্কে টানাপোড়েন চরমে

দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক সীমান্ত সংঘর্ষ ও প্রাণহানির পর কাতারের রাজধানী দোহায় একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তবে চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে ইতোমধ্যেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) তুর্কি সংবাদমাধ্যম টিআরটি ওয়ার্ল্ডে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মোহাম্মদ আসিফ রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “চুক্তির ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করছে আফগান তালেবান সরকারের ওপর। তারা যদি পাকিস্তানে হামলা চালানো সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ হয়, তাহলে যুদ্ধবিরতি বজায় থাকবে না।”

আসিফ আরও জানান, আফগান ভূখণ্ড থেকে যেকোনো হামলা বা অনুপ্রবেশ এই চুক্তির সরাসরি লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য হবে। তিনি বলেন, “আমরা স্পষ্টভাবে বলেছি—যতক্ষণ পর্যন্ত চুক্তির শর্ত রক্ষা করা হবে, ততক্ষণ যুদ্ধবিরতি বহাল থাকবে।”

চুক্তিতে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, তুরস্ক ও কাতার স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে অংশ নেয়। এতে বলা হয়েছে, কোনো পক্ষ সীমান্ত অতিক্রম করতে পারবে না এবং একে অপরের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সমর্থন করবে না।

টিটিপি কার্যক্রম ও তালেবানের ভূমিকা
পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছে যে, আফগানিস্তানে আশ্রয় নেওয়া তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) সদস্যরা সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে সন্ত্রাসী হামলা চালাচ্ছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী আসিফ বলেন, “টিটিপি আফগানিস্তান থেকেই আমাদের ভূখণ্ডে হামলা চালাচ্ছে এবং এই কর্মকাণ্ডে তারা তালেবান সরকারের নীরব সমর্থন পাচ্ছে।”

উল্লেখ্য, টিটিপি হচ্ছে একাধিক জঙ্গি গোষ্ঠীর একটি জোট, যার গঠন হয় ২০০৭ সালে। এ গোষ্ঠীর প্রধান লক্ষ্য পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠা।

পাকিস্তানি সেনা সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর এখন পর্যন্ত সন্ত্রাসী হামলায় ৩১১ সেনাসহ ৫০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে মূলত টিটিপির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।

আফগান তালেবানের প্রতিক্রিয়া
আফগান তালেবান সরকারের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। তালেবান মুখপাত্র জবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেন, “আমরা পাকিস্তানবিরোধী কোনো গোষ্ঠীকে আশ্রয় বা সমর্থন দিচ্ছি না। বরং ইসলামাবাদ মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে এবং নিজেদের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে।”

তিনি আরও জানান, দোহায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, উভয় দেশ একে অপরের বিরুদ্ধে কোনো শত্রুতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে না এবং কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে সমর্থন দেবে না।

সাম্প্রতিক বিমান হামলা ও পাল্টা প্রতিক্রিয়া
৯ অক্টোবর পাকিস্তান আফগান রাজধানী কাবুলে বিমান হামলা চালায়, যার লক্ষ্য ছিল টিটিপি নেতা নূর ওয়ালি মেহসুদ। যদিও হামলার পর মেহসুদ একটি ভিডিও বার্তায় জীবিত থাকার প্রমাণ দেন।

এ বিষয়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, “আমাদের ভূখণ্ডে যখন হামলা হয়, তখন আমরাও পাল্টা জবাব দিই। তারা যেখানে থাকবে, সেখানেই আঘাত করা হবে—চাহে তা কাবুল হোক বা অন্য কোথাও।”

পরবর্তী পদক্ষেপ ও আলোচনার পরিকল্পনা
পাকিস্তান ও আফগানিস্তান সীমান্তে শান্তি বজায় রাখার লক্ষ্যে আগামী ২৫ অক্টোবর তুরস্কের ইস্তাম্বুলে পরবর্তী বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে চুক্তির বাস্তবায়ন ও পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে বলে জানিয়েছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী আসিফ।

আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ ও উদ্বেগ
জাতিসংঘের ২০২৪ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আফগানিস্তানে এখনও ৬ হাজার থেকে সাড়ে ৬ হাজার টিটিপি জঙ্গি সক্রিয় রয়েছে এবং তারা মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীর ফেলে যাওয়া অস্ত্র ব্যবহার করছে। এই পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যেও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।

দুই দেশের মধ্যকার বর্তমান উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি কেবল সীমান্ত নিরাপত্তার বিষয় নয়, বরং এটি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ওপরও গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। যুদ্ধবিরতি টিকিয়ে রাখতে হলে উভয় পক্ষকে আস্থা ও তথ্যভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে পৌঁছাতে হবে—এই বাস্তবতাও ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

আন্তর্জাতিক শীর্ষ সংবাদ