যুক্তরাষ্ট্র ল্যাটিন আমেরিকা অঞ্চলে একটি বিমানবাহী রণতরীসহ পূর্ণাঙ্গ স্ট্রাইক গ্রুপ মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা ওই অঞ্চলে তাদের সামরিক উপস্থিতির এক নতুন স্তরে প্রবেশের সূচনা করতে পারে। মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই পদক্ষেপের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র মাদক চোরাচালান এবং অবৈধ কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে সক্ষমতা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। তবে বিশেষজ্ঞরা এই সামরিক মোতায়েনের উদ্দেশ্য নিয়ে একাধিক প্রশ্ন তুলছেন, বিশেষত ভেনেজুয়েলার পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে।
প্রতিরক্ষা দপ্তরের মুখপাত্র শন পারনেল জানান, ইউএসএস জেরাল্ড ফোর্ড নামক বিমানবাহী রণতরী এবং তার সঙ্গে থাকা পাঁচটি ডেস্ট্রয়ার ল্যাটিন আমেরিকা অঞ্চলে পাঠানো হবে। পেন্টাগন উল্লেখ করেছে, এই মোতায়েনের উদ্দেশ্য হচ্ছে অবৈধ কর্মকাণ্ড শনাক্ত, পর্যবেক্ষণ এবং প্রতিরোধের সক্ষমতা বাড়ানো। বর্তমানে মার্কিন বাহিনী ল্যাটিন আমেরিকায় আটটি যুদ্ধজাহাজ নিয়ে অবস্থান করছে, যেখানে ৬,০০০ নৌসেনা ও মেরিন সদস্য রয়েছে। এই অতিরিক্ত মোতায়েনের মাধ্যমে আরও ৪,৫০০ সামরিক সদস্য যোগ হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই সামরিক মোতায়েনের ঘটনা আসলে যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত লক্ষ্য—মাদক পাচার প্রতিরোধের চেয়ে অনেক বড় সামরিক শক্তি প্রদর্শন। এর প্রেক্ষিতে, ভেনেজুয়েলার দিকে মার্কিন প্রশাসনের কঠোর অবস্থান এবং সামরিক শক্তির প্রদর্শন নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠেছে। গত সপ্তাহে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সিআইএ-কে ভেনেজুয়েলায় কার্যক্রম চালানোর অনুমোদন দিয়েছেন এবং দেশটির ভেতরে শিগগিরই সামরিক হামলার ইঙ্গিত দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র তার আগ্রাসী নীতির দিকে আরও একটি পদক্ষেপ নিতে পারে, যা আন্তর্জাতিক শান্তি এবং নিরাপত্তা বিষয়ে নতুন বিতর্কের সৃষ্টি করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ল্যাটিন আমেরিকায় মাদক পাচারের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে কার্যক্রম চলছে, এবং এই বাহিনী মোতায়েনের মাধ্যমে তা আরও শক্তিশালী করা হবে। সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি বেড়ে যাওয়ার ফলে মাদক পাচার এবং অন্যান্য অবৈধ কার্যক্রমের ওপর নজরদারি বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। পেন্টাগন জানায়, স্ট্রাইক গ্রুপটি এই অঞ্চলে অবৈধ কার্যক্রমের উপর কড়া নজরদারি রাখবে এবং মাদক পাচারের সামগ্রিক প্রচেষ্টায় হস্তক্ষেপ করবে। তবে, এই পদক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে লাতিন আমেরিকার কিছু দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
এই সামরিক মোতায়েনের অন্য একটি বড় প্রভাব হতে পারে ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা। বিশেষ করে, ভেনেজুয়েলার সরকার উৎখাতের ইঙ্গিত আসন্ন হতে পারে। গত কয়েক বছর ধরে ভেনেজুয়েলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুবই উত্তপ্ত, এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে চাপ বাড়ানোর চেষ্টার মধ্যে সামরিক শক্তি প্রদর্শন তার পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। এমনকি কিছু আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক মনে করেন, এই পদক্ষেপ লাতিন আমেরিকায় এক নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে, যা আরও বড় আঞ্চলিক সংঘর্ষের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
মার্কিন বাহিনী বর্তমানে তাদের সবচেয়ে আধুনিক এবং শক্তিশালী রণতরী ইউএসএস জেরাল্ড ফোর্ডকে মোতায়েন করছে, যা বিমানবাহী রণতরী হিসেবে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ও শক্তিশালী। এই রণতরীটি প্রায় ১০,০০০ নৌসেনা এবং অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম বহনে সক্ষম। এছাড়াও, এই মোতায়েনের ফলে পাঁচটি ডেস্ট্রয়ারের উপস্থিতি নিশ্চিত করবে, যা সমুদ্রপথে দ্রুত অভিযানে সহায়ক। ইউএসএস জেরাল্ড ফোর্ড ইতিমধ্যেই ভূমধ্যসাগরে অবস্থান করছে এবং শিগগিরই ল্যাটিন আমেরিকায় পৌঁছাবে।
এছাড়াও, এই সামরিক পদক্ষেপের পরিণতি কেবল ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোর জন্যই নয়, বিশ্বব্যাপী সামরিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের ফলে ব্রাজিল, কলম্বিয়া, মেক্সিকোসহ অন্যান্য দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া এবং তাদের সামরিক প্রস্তুতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চোখ এখন এই পরিস্থিতির ওপর। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, এই পদক্ষেপের ফলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের তীব্রতা আরও বাড়তে পারে এবং তা বৈশ্বিক অস্থিরতার কারণ হতে পারে।
মার্কিন সামরিক উপস্থিতির বৃদ্ধি, বিশেষত ভেনেজুয়েলা এবং ল্যাটিন আমেরিকার অন্যান্য দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, এক নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে। এটি শুধুমাত্র মাদক পাচার প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে নয়, বরং এক বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক ইঙ্গিত বহন করছে, যা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে। এখন সময় আসছে বিশ্ব ক্ষমতাসমূহের জন্য কৌশলগতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার, যেন এই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সম্ভব হয়।


