পাকিস্তান আফগানিস্তানের সাথে সীমান্ত এবং বাণিজ্য একতরফাভাবে স্থগিত ঘোষণা করেছে

পাকিস্তান আফগানিস্তানের সাথে সীমান্ত এবং বাণিজ্য একতরফাভাবে স্থগিত ঘোষণা করেছে

পাকিস্তান সরকার আফগানিস্তানের সঙ্গে সমস্ত সীমান্ত ক্রসিং এবং বাণিজ্য একতরফাভাবে স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র তাহির হুসাইন আন্দারবি গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, আফগান সীমান্ত ক্রসিং এবং বাণিজ্য আপাতত বন্ধ থাকবে এবং এই নিষেধাজ্ঞা কেবল নিরাপত্তা পরিস্থিতির মূল্যায়ন শেষে পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত কার্যকর থাকবে।

এ পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, দেশটির জনগণের নিরাপত্তা তাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার, এবং সীমান্ত খুলে বাণিজ্য চলাতে গিয়ে নিরাপত্তার ঝুঁকি নিতে তারা রাজি নয়।

পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের মধ্যে সীমান্ত সমস্যা এবং নিরাপত্তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিরোধ চলছে। পাকিস্তান অভিযোগ করে আসছে যে, আফগানিস্তানের তালেবান সরকার পাকিস্তানের মধ্যে তালেবানপন্থি গোষ্ঠী তেহরিক-ই তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)-কে মদত দিচ্ছে। আফগানিস্তান এই অভিযোগ বারবার অস্বীকার করেছে, তবে সম্প্রতি কাবুলের বিমান হামলায় পাকিস্তানের টিটিপি নেতাদের হত্যার পর পরিস্থিতি আরও তিক্ত হয়ে উঠেছে।

এ বিষয়ে, ৯ অক্টোবর কাবুলে আফগানিস্তানের বিমানবাহিনী একটি হামলা চালিয়ে টিটিপির শীর্ষ নেতা নূর ওয়ালি মেহসুদসহ কয়েকজন উচ্চপদস্থ নেতাকে হত্যা করে। এর পর পাকিস্তান এই হামলাকে তার সার্বভৌমত্বে আঘাত হিসেবে আখ্যা দেয় এবং ১১ অক্টোবর আফগান সেনাবাহিনী পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তে পাকিস্তানি সেনাচৌকিগুলোকে লক্ষ্য করে হামলা চালায়।

পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে টানা ৪ দিন সংঘর্ষ চলে। এই সংঘাতে ২০০-র বেশি আফগান সেনা এবং ২৩ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। ১৫ অক্টোবর উভয় দেশ ৪৮ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেয়, যা পরবর্তীতে কাতারে অনুষ্ঠিত এক সংলাপের পর আরও বাড়ানো হয়।

যুদ্ধবিরতি স্থগিত থাকার পর, ১৭ অক্টোবর কাতারের দোহায় পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের সরকারি প্রতিনিধিরা এক বৈঠকে বসেন। তবে, এই বৈঠকেও কোনো স্থায়ী সমাধান না আসায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।

পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে প্রায় ২৩০ কোটি ডলারের বার্ষিক বাণিজ্য হয়ে থাকে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক সীমান্ত ক্রসিং হলো তোরখাম, যেখানে প্রতিদিন শত শত ট্রাক পণ্য নিয়ে দুই দেশের মধ্যে যাতায়াত করে। পাকিস্তান থেকে তাজা ফল, শাক-সবজি, খাদ্যদ্রব্য, খনিজ পদার্থ, ওষুধ, গম, চাল, চিনি, মাংস এবং দুগ্ধজাত পণ্য আফগানিস্তানে চলে যায়।

এখন, সীমান্ত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই পণ্যগুলো আটকে আছে এবং বাণিজ্যিক অপারেশন ব্যাহত হচ্ছে। তোরখাম সীমান্তের দু’পাশে প্রায় ৫,০০০ ট্রাক দাঁড়িয়ে রয়েছে, যেগুলোর চালকরা সীমান্ত খুলে যাওয়ার অপেক্ষায় আছেন। এর ফলে দেশ দুটি বাণিজ্যিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং পাকিস্তানে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। বিশেষ করে, সম্প্রতি পাকিস্তানে টমেটোর দাম পাঁচগুণ বেড়েছে।

পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে এই বাণিজ্যিক বিরতি শুধু দুই দেশের অর্থনীতি নয়, দক্ষিণ এশিয়ার অঞ্চলের বাণিজ্যিক পরিবহণেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। পাকিস্তানের বাজারে আফগান পণ্যের সংকট সৃষ্টি হতে পারে, যা স্থানীয় বাজারে দাম বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। অন্যদিকে, আফগানিস্তানেও বাণিজ্যের অপ্রতুলতা এবং খাদ্যপণ্যের অভাব দেখা দিতে পারে, যা দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতায় প্রভাব ফেলবে।

বৈশ্বিক নিরাপত্তা বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের মধ্যে এমন বিরোধপূর্ণ সম্পর্কের কারণে কেবল বাণিজ্যিক ক্ষতি নয়, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সীমান্তের নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে। এতে এই অঞ্চলে বড় ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে, যা কেবল পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানই নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর জন্যও উদ্বেগের কারণ হতে পারে।

এই অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তত্ত্বাবধানে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানকে আলোচনার মাধ্যমে একটি স্থায়ী সমাধানে পৌঁছানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে, উভয় দেশের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি সঠিকভাবে স্থিতিশীল না হলে, সীমান্তের এই বিরতি দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে, যার ফলস্বরূপ আরো ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি এবং সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে।

আন্তর্জাতিক শীর্ষ সংবাদ