গৌতম আদানির বিরুদ্ধে বিতর্কিত সরকারি সহায়তা: ঝুঁকি ও রাজনীতির সম্পর্ক

গৌতম আদানির বিরুদ্ধে বিতর্কিত সরকারি সহায়তা: ঝুঁকি ও রাজনীতির সম্পর্ক

ভারতের অন্যতম শীর্ষ ধনী ব্যবসায়ী গৌতম আদানি সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় সমর্থনের মাধ্যমে একটি বড় আর্থিক সংকট কাটিয়ে উঠেছেন, যা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা তৈরি করেছে। গৌতম আদানির ব্যবসা গত বছর উল্লেখযোগ্য সংকটের মধ্যে পড়েছিল, বিশেষ করে যখন যুক্তরাষ্ট্রে তার বিরুদ্ধে ঘুষ এবং জালিয়াতির অভিযোগ তোলা হয়েছিল। এর ফলে বিশ্বের বড় বড় ব্যাংকগুলো তাকে ঋণ দিতে সায় দিচ্ছিল না, তবে ভারতীয় সরকার নীরবে তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল।

দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের একটি প্রতিবেদনে জানা গেছে, মে মাসে ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (ডিএফএস) রাষ্ট্রায়ত্ত লাইফ ইনস্যুরেন্স করপোরেশন অব ইন্ডিয়া (এলআইসি)কে গৌতম আদানির মালিকানাধীন আদানি গ্রুপে প্রায় ৩৯০ কোটি ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করার নির্দেশ দেয়। এলআইসি মূলত দরিদ্র জনগণকে জীবনবিমা সেবা দিয়ে থাকে, যা এর লক্ষ্য ও দায়িত্বের পরিপন্থী বলে সমালোচনা উঠেছে।

একই সময়, আদানি গ্রুপের একটি বন্দর ইউনিটের ঋণ পুনঃ অর্থায়নের জন্য ৫৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার প্রয়োজন ছিল। এলআইসি এই পরিমাণ অর্থ সরাসরি বন্ডের মাধ্যমে মঞ্জুর করে। এতে প্রশ্ন উঠেছে—এটি কি জনগণের অর্থের অপব্যবহার নয়?

নির্বাচিত বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘটনা ভারতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বেশ গুরুত্ব বহন করে। বিশেষত, হেমেন্দ্র হাজারি, একজন করপোরেট খাতের বিশ্লেষক বলেন, ‘‘এই সরকার আদানিকে রক্ষা করবে, তার কোনো ক্ষতি হতে দেবে না।’’ আদানি গ্রুপের সমর্থনে ভারতীয় সরকারের সক্রিয় ভূমিকা এক ধরনের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা হিসেবে দেখা যাচ্ছে, যা জনগণের অর্থ ব্যবস্থাপনায় প্রশ্ন তুলেছে।

এলআইসি এবং নীতি আয়োগের মধ্যে সমন্বয় করে এই বিনিয়োগ পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল আদানি গ্রুপের প্রতি বাজারের আস্থা পুনরুদ্ধার করা এবং অন্যান্য বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করা। ২০২৩ সালে আদানির ঋণ প্রায় ২০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল, ফলে তিনি ক্রমবর্ধমান আর্থিক চাপের মধ্যে পড়েছিলেন।

গৌতম আদানির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিনিয়োগ আকর্ষণের অভিযোগ আনা হয়েছিল এবং সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) আদানির বিরুদ্ধে সিকিউরিটিজ আইনভঙ্গের মামলা করে। তবে আদানি গ্রুপ পাল্টা দাবি করেছে যে এই অভিযোগগুলো তাদের কোম্পানির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, বরং ব্যক্তিগত দোষের বিষয়।

এদিকে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের আইন বিশেষজ্ঞ কুশ আমিন মন্তব্য করেছেন, ‘‘এলআইসি একটি দরিদ্র জনগণকে সেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠান। এমন ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ তাদের মূল লক্ষ্য ও দায়বদ্ধতার পরিপন্থী।’’ তার মতে, এলআইসি যদি প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন সংস্থা হত, তাহলে তারা এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিত না।

গৌতম আদানি ভারতের অর্থনীতির অন্যতম শীর্ষ চরিত্রে পরিণত হয়েছেন। তার অধীনে থাকা বন্দর এবং বিদ্যুৎ খাতে তার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। তিনি দেশের মোট পণ্য পরিবহনের ২৭ শতাংশ আদানি গ্রুপের বন্দরগুলির মাধ্যমে করেন। এছাড়া, তিনি ভারতের নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে সবচেয়ে বড় বেসরকারি বিনিয়োগকারী।

এছাড়া, ২০২২ সালে তিনি ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় টেলিভিশন চ্যানেল এনডিটিভি অধিগ্রহণ করেন। এর ফলে তিনি সেসময় বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী হয়ে ওঠেন, তার পিছনে ছিল কেবল ইলন মাস্ক।

আদানি ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। গুজরাটে তাদের শিকড় এবং ব্যবসায়িক সম্পর্কের গভীরতা অনেক পুরনো। ২০১৪ সালে মোদির নির্বাচনী প্রচারণায় আদানি গ্রুপের বিমান ব্যবহৃত হয়েছিল। এ ধরনের সম্পর্কের কারণে বিরোধী রাজনীতিকরা আদানি-মোদি সম্পর্ক নিয়ে বারবার প্রশ্ন তুলেছেন।

অস্ট্রেলীয় গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ক্লাইমেট এনার্জি ফাইন্যান্সের পরিচালক টিম বাকলি বলেছেন, ‘‘এটা স্পষ্ট যে আদানি গ্রুপকে ভারত সরকার ‘ভিন্ন নিয়মে’ ব্যবসা করার সুযোগ দিয়েছে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘ভারত সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে, তবে এখনো স্বজনতোষণনির্ভর পুঁজিবাদ চলছেই।’

গৌতম আদানি এখন ভারতের অর্থনীতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছেন। তবে প্রশ্ন উঠছে, দেশের বৃহত্তম সরকারি প্রতিষ্ঠান এলআইসি কীভাবে ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগে অংশ নিল? এর ফলে জনগণের অর্থের নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে অনেকেই সন্দিহান।

সরকারি ও বেসরকারি খাতে আদানি গ্রুপের প্রভাব এবং এই গ্রুপের ভবিষ্যৎ যে শুধু ভারতের নয়, বিশ্ব অর্থনীতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, তা স্পষ্ট।

আন্তর্জাতিক শীর্ষ সংবাদ