মাহনূর ওমারের সংগ্রাম: পাকিস্তানে নারীদের মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এক বৃহত্তর আন্দোলন

মাহনূর ওমারের সংগ্রাম: পাকিস্তানে নারীদের মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এক বৃহত্তর আন্দোলন

পাকিস্তানের নারীদের মাসিক স্বাস্থ্য এবং স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্রাপ্যতা নিয়ে যে লড়াই চলছে, তার প্রধান মুখ মাহনূর ওমার। ২৫ বছর বয়সী এই আইনজীবী ও নারী অধিকারকর্মী প্রথম নারীদের মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন মাত্র ১৬ বছর বয়সে। সেই সময় থেকেই তিনি উপলব্ধি করেন যে, পাকিস্তানে স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবহার এবং মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে প্রচলিত সামাজিক চিত্র অত্যন্ত সংকীর্ণ এবং প্রতিকূল। তাঁর এই লড়াই শুধু স্যানিটারি ন্যাপকিনের উপর করের বিরোধিতার মাধ্যমে নয়, বরং একটি বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে, যা পাকিস্তানের নারীদের মৌলিক স্বাস্থ্য অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম।

মাহনূর ওমারের সবার নজরে আসা কাজটি ছিল স্যানিটারি ন্যাপকিনের উপর পাকিস্তান সরকারের আরোপিত ‘মাসিক কর’ের বিরুদ্ধে পিটিশন দাখিল করা। ১৯৯০ সালের সেলস ট্যাক্স আইনের অধীনে পাকিস্তানে স্যানিটারি ন্যাপকিনের উপর ১৮ শতাংশ বিক্রয় কর আরোপ করা হয়, এবং আমদানিকৃত ন্যাপকিনের উপর ২৫ শতাংশ কাস্টমস শুল্ক আরোপ করা হয়। ইউনিসেফ পাকিস্তান জানাচ্ছে যে, এই করগুলির ফলে স্যানিটারি ন্যাপকিনের দাম প্রায় ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়, যা দেশের নারীদের জন্য একটি বড় আর্থিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

এটি শুধু আর্থিক ক্ষতির বিষয় নয়, বরং পাকিস্তানের অনেক অঞ্চলে মাসিক বিষয়টি এখনো একটি ট্যাবু হিসেবে গণ্য হয়, এবং স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবহারও সমাজে এক ধরনের লজ্জা সৃষ্টি করে। মাহনূর ও তাঁর সহকর্মী আইনজীবী আহসান জাহাঙ্গীর খান মনে করেন, এই কর নারীদের স্বাস্থ্য অধিকার ও মর্যাদাকে অবমূল্যায়ন করছে এবং এটি একটি বৈষম্যমূলক আচরণের অংশ।

মাহনূরের পিটিশনে সরকারের বিরুদ্ধে শুধু স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্রাপ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়নি, বরং এটি একটি বৃহত্তর সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রশ্ন হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, পাকিস্তানের মতো সমাজে যেখানে নারীর প্রতি বৈষম্য ও সামাজিক বাধা অত্যন্ত গভীর, সেখানে এই পিটিশন একটি বড় ধরনের সামাজিক পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে। তিনি একে ‘নারী বনাম পাকিস্তান’ বলেই অভিহিত করেন, কারণ এটি শুধুমাত্র একটি আইনি লড়াই নয়, বরং একটি জাতীয় আন্দোলনের অঙ্গ।

মাহনূর ওমারের লড়াই শুধু আইনি পরিসরে নয়, বরং সামাজিক পরিবর্তনের জন্যও ছিল। ১৬ বছর বয়সে তিনি ইসলামাবাদের একটি নিম্ন আয়ের এলাকায় নারীদের জন্য ‘ডিগনিটি কিট’ তৈরি শুরু করেন। এই কিটগুলোতে স্যানিটারি ন্যাপকিন, অন্তর্বাস, ব্যথানাশক ওষুধ এবং টিস্যু অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাঁর এই উদ্যোগের মাধ্যমে প্রায় ৩০০টি কিট নারীদের মধ্যে বিতরণ করা সম্ভব হয়েছিল। এটি ছিল একটি ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যার মাধ্যমে তিনি নারীদের মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করেছিলেন।

মাহনূর এখন লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা করছেন, এবং তাঁর পরিকল্পনা পাকিস্তানে ফিরে এসে নারীদের মাসিক স্বাস্থ্য এবং অধিকার নিয়ে আরও কার্যক্রম শুরু করার। তাঁর মত, পাকিস্তানে নারীর স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা এখনও খুবই সীমিত এবং অনির্ধারিত। তিনি মনে করেন, স্যানিটারি ন্যাপকিনের উপর ‘মাসিক কর’ বাতিল করা কেবল একটি আইনি পদক্ষেপ নয়, এটি একটি বৃহত্তর সামাজিক সচেতনতা এবং নারীদের স্বাস্থ্য অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ খুলে দিতে পারে।

মাহনূর ও তাঁর সহকর্মীরা আশা করেন, পাকিস্তানে স্যানিটারি ন্যাপকিনের উপর ‘মাসিক কর’ বাতিলের পিটিশন একটি প্রভাব ফেলবে, এবং পাকিস্তান ভারতের মতো অন্যান্য দেশগুলোর মতো এই কর বাতিল করবে। তাঁর বিশ্বাস, এই পিটিশনের মাধ্যমে পাকিস্তানে নারীদের মাসিক স্বাস্থ্য এবং অধিকার নিয়ে যে দীর্ঘদিনের নিস্তব্ধতা ছিল, তা ভেঙে যাবে। এটি হবে এক নতুন সামাজিক পরিবর্তনের সূচনা, যেখানে নারীরা নিজের স্বাস্থ্য এবং অধিকার সম্পর্কে আরও সচেতন হয়ে উঠবে।

মাহনূর ওমারের সংগ্রাম শুধুমাত্র পাকিস্তান নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় নারীদের স্বাস্থ্য ও অধিকার নিয়ে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দিতে পারে। তাঁর কাজ শুধু আইনি ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি একটি বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে, যা নারীদের সমঅধিকার ও মর্যাদার প্রশ্নে গতি এনে দেবে। মাহনূরের মতো নারীদের সাহসী পদক্ষেপসমূহ সমাজে পরিবর্তন আনার প্রেরণা হতে পারে, যা নারীদের স্বাস্থ্য এবং অধিকার নিয়ে আরও সঠিক এবং কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণে সহায়ক হবে।

আন্তর্জাতিক