জাতীয় ঐকমত্য কমিশন আগামীকাল মঙ্গলবার সরকারের কাছে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায়সংক্রান্ত চূড়ান্ত সুপারিশ হস্তান্তর করবে। রাজধানীর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় দুপুর ১২টায় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের উপস্থিতিতে কমিশনের পক্ষ থেকে এই সুপারিশ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রদান করা হবে।
সোমবার (২৭ অক্টোবর) বিকেলে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় কমিশনের সমাপনী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক বার্তায় বিষয়টি জানানো হয়।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সহসভাপতি প্রফেসর আলী রীয়াজ, সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
সমাপনী বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূস জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম সম্পর্কিত সব নথি, অডিও-ভিডিও রেকর্ড, চিঠিপত্র এবং ছবি সংরক্ষণের নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, “এগুলো জাতির ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করা জরুরি। আমরা কোন প্রেক্ষাপটে, কীভাবে এবং কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম—তা গবেষণা ও শিক্ষার জন্য উন্মুক্ত থাকা উচিত।”
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, “যত বৈঠক হয়েছে, যত চিঠিপত্র বিনিময় হয়েছে, কিংবা টেলিভিশনে সরাসরি প্রচারিত সংলাপ—সবকিছু যথাযথভাবে শ্রেণিবিন্যাস করে সংরক্ষণ করতে হবে। এগুলো ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সংস্কার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে।”
তিনি কমিশনের সদস্য, রাজনৈতিক দল, গবেষক ও গণমাধ্যম কর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং তাদের অবদানের প্রশংসা করেন।
বৈঠকে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের রূপরেখা চূড়ান্ত করার পাশাপাশি অন্য সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
কমিশনের সহসভাপতি প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেন, “জাতীয় ঐকমত্য কমিশন একটি জবাবদিহিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি স্থাপন করেছে। রাজনৈতিক দল, আইন বিশেষজ্ঞ, বিচারপতি, শিক্ষাবিদ এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার ভিত্তিতে সুপারিশগুলো চূড়ান্ত করা হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “চব্বিশের জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম দায়িত্ব ছিল কাঠামোগত সংস্কার। কমিশনের কাজ ছিল সেই সংস্কারের একটি সুসংগঠিত রূপরেখা তৈরি করা। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা সবাই ভাগাভাগি করেছে, যা আমাদের জন্য আশাব্যঞ্জক।”
নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে সরকারের দৃঢ়তা ও সাহসিকতা অপরিহার্য। গণ-অভ্যুত্থানে যারা প্রাণ দিয়েছেন, তাদের ত্যাগের যথার্থ মর্যাদা দিতে হলে ঘোষিত সংস্কারগুলো নিশ্চিত করতে হবে।”
কমিশন সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক বলেন, “গণ-অভ্যুত্থানের সময় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে ঐক্য ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা ছিল, কমিশনের আলোচনাতেও তার প্রতিফলন দেখা গেছে। এটি একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত।”
পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ বলেন, “প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক দলগুলো ধৈর্যের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনায় অংশ নিয়েছে। ভবিষ্যতেও এই ধরনের সংলাপ ও সহযোগিতা বজায় থাকা প্রয়োজন।”
দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পাশাপাশি দুদকের কাঠামোগত সংস্কারও জরুরি। জবাবদিহিমূলক প্রশাসন গঠনে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।”
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার বলেন, “শহীদ পরিবারের সদস্যরা আমাদের জানিয়েছেন, সংস্কার কার্যকর না হলে তারা মনে করবেন তাদের প্রিয়জনদের আত্মত্যাগ বৃথা গেছে। জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মূল চেতনা সংরক্ষণ করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।”
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রমের মেয়াদ আগামী ৩১ অক্টোবর শেষ হবে। কমিশন সদস্যরা জানিয়েছেন, সরকারের প্রয়োজন হলে তাঁরা ভবিষ্যতেও নাগরিক হিসেবে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।
কমিশনের সদস্যদের মতে, জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী এই প্রক্রিয়া বাংলাদেশে স্থায়ী সংস্কার ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠনের এক নতুন অধ্যায় উন্মোচন করেছে। তারা আশা প্রকাশ করেন, সরকার সুপারিশগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করবে, যাতে জনগণ কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের প্রতিফলন দেখতে পায়।


