৯৫ শতাংশ কম খরচে এআই বাজারে আলোড়ন তুলেছে চীনের ডিপসিক

৯৫ শতাংশ কম খরচে এআই বাজারে আলোড়ন তুলেছে চীনের ডিপসিক

প্রযুক্তি ডেস্ক

চীনের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ডিপসিক মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে প্রযুক্তিবিশ্বে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে। প্রতিষ্ঠানটি সম্প্রতি ২০ জানুয়ারি প্রকাশ করেছে তাদের নতুন এআই মডেল আর১ (R1), যা দাবি করা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওপেনএআইয়ের জিপিটি–৪ও মডেলের সমকক্ষ কর্মক্ষমতা অর্জন করেছে মাত্র ৫ শতাংশ খরচে।

জেজ্যাং বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল প্রকৌশলীর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ডিপসিক জানিয়েছে, তাদের নতুন মডেলটি প্রশিক্ষণ দিতে খরচ হয়েছে মাত্র ৫৬ লাখ ডলার, যেখানে ওপেনএআইয়ের জিপিটি–৪ও মডেলের প্রশিক্ষণ ব্যয় ছিল প্রায় ১০০ কোটি ডলারেরও বেশি। এআই সেবার ক্ষেত্রে প্রতি ১০ লাখ টোকেনের জন্য ওপেনএআই যেখানে ১৫ ডলার নেয়, সেখানে ডিপসিক নিচ্ছে মাত্র ২ ডলার ১৯ সেন্ট। ফলে বাণিজ্যিক ব্যবহারকারীদের জন্য খরচ প্রায় ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাচ্ছে।

প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, তাদের লক্ষ্য কেবল উন্নত এআই তৈরি নয়, বরং এমন অ্যালগরিদম ও প্রোগ্রামিং কাঠামো নির্মাণ যা উচ্চক্ষমতার হার্ডওয়্যার ও অতিরিক্ত বিদ্যুৎ নির্ভরতা ছাড়াই উন্নত কর্মক্ষমতা দিতে পারে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি লাভজনক অবস্থায় রয়েছে বলে ডিপসিকের দাবি, যদিও ওপেনএআই এখনো সেই অবস্থানে পৌঁছায়নি।

ডিপসিকের আর১ মডেলটি চালানো হয়েছে এনভিডিয়া এইচ৮০০ এআই অ্যাকসেলারেটর–এর মাধ্যমে, যা ওপেনএআই ব্যবহৃত এইচ১০০ চিপের তুলনায় তুলনামূলকভাবে কম শক্তিশালী। তবুও পারফরম্যান্সের মান রক্ষা করায় প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বিষয়টি নিয়ে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

কম খরচে শক্তিশালী মডেল উন্মোচনের খবর প্রকাশের পর তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়ে শেয়ারবাজারে। বিনিয়োগকারীরা ধারণা করেন, ডিপসিকের মতো প্রতিষ্ঠান যদি সাশ্রয়ী এআই সেবা দিতে পারে, তবে পশ্চিমা এআই কোম্পানিগুলোর রাজস্ব হ্রাস পাবে। ফলস্বরূপ, এনভিডিয়ার বাজারমূল্য এক দিনে প্রায় ৬০ হাজার কোটি ডলার কমে যায়—যা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এক দিনের সর্বোচ্চ দরপতন। পাশাপাশি গুগল, অ্যামাজন, মাইক্রোসফট ও ওপেনএআই–সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শেয়ারমূল্যেও পতন ঘটে।

ডিপসিক তাদের সমস্ত এআই মডেল ওপেনসোর্স হিসেবে উন্মুক্ত করেছে, যাতে ব্যবহারকারীরা নিজেরাই কোড পরীক্ষা করতে এবং নিজেদের কম্পিউটারে তা চালাতে পারেন। এর ফলে ক্লাউডনির্ভর সেবার পরিবর্তে স্থানীয়ভাবে এআই ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে চীনা প্রযুক্তি নিয়ে যে অবিশ্বাস বিদ্যমান, সেটি দূর করতেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

এরই মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ডিপসিকের ওপেনসোর্স মডেল ব্যবহার করে নিজেদের সেবা উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর ফলে এআই বাজারে গুগল, মেটা ও ওপেনএআইয়ের আধিপত্য কমে গিয়ে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি হবে।

তবে ডিপসিকের দাবিগুলো নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন একাধিক এআই বিশেষজ্ঞ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্কেল এআই–এর প্রধান নির্বাহী আলেক্সান্ডার ওয়াং দাবি করেছেন, শুধুমাত্র এইচ৮০০ চিপ ব্যবহার করে এত উন্নত মডেল তৈরি করা সম্ভব নয়। তার অভিযোগ, ডিপসিক হয়তো অবৈধভাবে প্রায় ৫০ হাজার এইচ১০০ চিপ সংগ্রহ করেছে এবং তাদের মডেলের কিছু অংশ ওপেনএআইয়ের জিপিটি–ও১ থেকে নকল করা।

এ ছাড়া গবেষকরা অভিযোগ করেছেন, ডিপসিক ওপেনএআইয়ের সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট কিট (SDK)–এর কিছু উপাদান ব্যবহার করছে, যা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানের জন্য সুবিধাজনক হতে পারে। ফলে ওপেনএআইয়ের বর্তমান গ্রাহকরা সামান্য কোড পরিবর্তন করেই ডিপসিকের সেবা গ্রহণ করতে পারছেন।

সম্প্রতি সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান উইজ জানিয়েছে, ডিপসিকের একটি ক্লিকহাউস ডেটাবেসে দুর্বলতা ছিল, যার মাধ্যমে অননুমোদিতভাবে তথ্যের অ্যাক্সেস পাওয়া সম্ভব ছিল। প্রতিষ্ঠানটি দ্রুত সমস্যাটি সমাধান করলেও তথ্য নিরাপত্তা নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে।

এই ঘটনার পর ইতালির সরকার ব্যবহারকারীর গোপনীয়তা সুরক্ষায় ব্যর্থতার অভিযোগে ডিপসিকের সেবা দেশে নিষিদ্ধ করেছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও কয়েকটি দেশেও ডিপসিকের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে।

বর্তমানে অ্যাপল ও গুগল অ্যাপ স্টোরে সবচেয়ে জনপ্রিয় অ্যাপগুলোর তালিকার শীর্ষে রয়েছে ডিপসিক। হঠাৎ বিপুল সংখ্যক ব্যবহারকারী যুক্ত হওয়ায় সার্ভার পরিচালনায় চাপের মুখে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। অন্যদিকে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যবহারকারীরা ডিপসিকের সীমাবদ্ধতা নিয়ে নানা রসিকতা ও মিম তৈরি করলেও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মতে, এর আগমন বিশ্বব্যাপী এআই প্রতিযোগিতায় নতুন এক অধ্যায় সূচিত করেছে।

বিশ্লেষকদের ধারণা, ডিপসিকের উদ্ভাবন পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে এআই প্রযুক্তির প্রতিযোগিতাকে আরও তীব্র করবে। এতে এআই খাতের মূল্য, প্রযুক্তি মানদণ্ড এবং নৈতিকতার প্রশ্নে নতুন ভারসাম্য তৈরি হতে পারে।

তথ্য প্রুযুক্তি