জাতীয় ডেস্ক
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া রায়ের পেছনে অসৎ উদ্দেশ্য ছিল বলে মন্তব্য করেছেন রাষ্ট্রের প্রধান আইনজীবী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।
বুধবার (৫ নভেম্বর) প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সাত সদস্যের বেঞ্চে ওই রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলের শুনানিতে তিনি এ দাবি করেন। শুনানিতে অংশ নেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার অনীক আর হক।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক যেদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের ‘শর্ট অর্ডার’ ঘোষণা করেন, সেদিনই সেটি ছিল রায়ের দিন। কিন্তু ঘোষিত রায় ১৬ মাস পর পরিবর্তন করা হয়, যা আইন ও প্রচলিত রীতির পরিপন্থি। তার ভাষায়, “এই পরিবর্তন নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে করা হয়েছে, যা দণ্ডবিধির ২১৯ ধারার আওতাধীন অপরাধ।”
তিনি আরও বলেন, “যদি কোনো সরকারি কর্মকর্তা বিদ্বেষপূর্ণভাবে এমন কোনো আদেশ বা রায় দেন যা আইনবিরুদ্ধ বলে তিনি জানেন, তবে তিনি সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।”
শুনানির সময় তিনি অভিযোগ করেন, রায় ঘোষণার পর তা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কোনো বৈধ বিচারিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। “হাকিম নড়লে হুকুম নড়ে না। কিন্তু এখানে হুকুমটাই নড়ানো হয়েছে,”—বলেন অ্যাটর্নি জেনারেল। তিনি যুক্তি দেন, রায় পরিবর্তনের একমাত্র বৈধ উপায় হলো রিভিউ আবেদন বা আদালতের স্বপ্রণোদিত উদ্যোগ (সুয়োমটো), যা এখানে অনুসৃত হয়নি।
এর আগে ২১ অক্টোবর থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে করা এই আপিলের শুনানি শুরু হয়। এ পর্যন্ত আট কার্যদিবসে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। আদালত বৃহস্পতিবার (৬ নভেম্বর) পরবর্তী শুনানির তারিখ নির্ধারণ করেছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ১৯৯৬ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনের মাধ্যমে প্রবর্তিত হয়। তবে ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ওই ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়। এর আগে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ ওই ব্যবস্থা অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছিল।
রায়টি সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে গৃহীত হয়েছিল। সংক্ষিপ্ত রায়ে উল্লেখ ছিল, সংসদ চাইলে আরও দুটি নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বজায় রাখতে পারে। তবে পরবর্তীতে প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ বিষয়ে কোনো উল্লেখ ছিল না, যা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্ক রয়েছে।
গত বছর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ওই রায়ের পুনর্বিবেচনা চেয়ে পাঁচজন বিশিষ্ট নাগরিক এবং রাজনৈতিক নেতারা পৃথক রিভিউ আবেদন করেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন ‘সুশাসনের জন্য নাগরিক’ (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেন।
এই রিভিউ আবেদনগুলোর ওপর শুনানি শেষে গত ২৭ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ আপিলের অনুমতি (লিভ টু আপিল) মঞ্জুর করে। এরপর থেকেই বর্তমান শুনানি শুরু হয়েছে।
শুনানিতে সংবিধানের পটভূমি ও রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রসঙ্গ টেনে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সংবিধান গৃহীত হওয়ার মাধ্যমে দেশে আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পথচলা শুরু হয়েছিল। কিন্তু দুই বছরের মাথায় গণতন্ত্র হত্যার মধ্য দিয়ে সেই পথ রুদ্ধ হয়।”
তিনি আরও বলেন, “একদলীয় শাসনের সময় বাক্স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছিল, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। তখন প্রায় ৩০ হাজার মানুষ হত্যার শিকার হয়েছিলেন। এটি ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল এক দৃষ্টান্ত।”
১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রসঙ্গে আসাদুজ্জামান বলেন, “সেই সময় সামরিক শাসনের মধ্য দিয়েই জনগণ মুক্তি পেয়েছিল, ভোটাধিকার ফিরে এসেছিল। আজকের আওয়ামী লীগ সেই সামরিক শাসনের করুণায় পুনরায় রাজনীতিতে ফিরে আসে।”
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিকে ঘিরে এই মামলার ফলাফল বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে বলে আইনজীবী মহলে ধারণা করা হচ্ছে। আদালতে পরবর্তী শুনানি বৃহস্পতিবার (৬ নভেম্বর) অনুষ্ঠিত হবে।


