আবু কাওসার ;এবারের বাজেট পাসের ২০ দিনের মাথায় নতুন মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আইনে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে সরকার। ভ্যাট ফাঁকি রোধে প্রায় ১৭০টি পণ্য ও সেবা খাতে ভ্যাট আদায় ‘বাধ্যতামূলক’ করা হয়েছে। এর মধ্যে ম্যানুফ্যাকচারিং বা উৎপাদন পর্যায়ে পণ্যের সংখ্যা ৯০টি, বাকিগুলো সেবা খাতের।
গতকাল রোববার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এ বিষয়ে আদেশ জারি করেছে। গতকাল জারি করা হলেও আদেশ কার্যকর ধরা হয়েছে ১ জুলাই থেকে। এনবিআর সূত্র বলেছে, এসব পণ্য ও সেবা খাতে ভ্যাট আদায়ে ব্যাপক অপব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ফাঁকি বন্ধে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
নতুন আইনে ভ্যাটের বার্ষিক অব্যাহতি সীমা ৩০ লাখ টাকার পরিবর্তে ৫০ লাখ টাকা এবং টার্নওভার বা লেনদেনে সীমা ৮০ লাখ থেকে ৩ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। ১ জুলাই থেকে নতুন আইন কার্যকর হয়।
সূত্র বলেছে, নতুন ভ্যাট আইন কার্যকরের ফলে দেখা যায়, ভ্যাটের অব্যাহতি এবং টার্নওভার সীমায় ছাড় দেওয়ার ফলে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের বিক্রির লেনদেনের তথ্য গোপন করে সরকারের দেওয়া সুযোগ নিয়ে কারসাজি করছে। ফলে এরই মধ্যে কয়েক হাজার ‘ভ্যাটযোগ্য’ প্রতিষ্ঠান আওতার বাইরে চলে গেছে। তারা ভ্যাট দিচ্ছে না। এতে করে সরকারের রাজস্ব আহরণে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এনবিআরের নতুন আদেশের ফলে আগে যারা ভ্যাট থেকে অব্যাহতি পেয়েছিল তাদেরও এখন ভ্যাট দিতে হবে। ভ্যাট কর্মকর্তারা বলেছেন, বিক্রি যাই হোক না কেন, উল্লিখিত পণ্য ও সেবা খাতের সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাট দিতেই হবে। নতুন আইনে ভ্যাটের যে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, এসব ব্যবসায় সেই সুযোগ প্রযোজ্য হবে না।
এনবিআরের আদেশে বলা হয়, ‘টার্নওভার নির্বিশেষে’ এসব পণ্য এবং সেবা খাতে প্রযোজ্য হারে ‘অবশ্যই’ ভ্যাট দিতে হবে। অর্থাৎ আইনে বছরে ৫০ লাখ টাকা বিক্রি পর্যন্ত অব্যাহতি, একই সঙ্গে ৫০ লাখ থেকে তিন কোটি টাকা বিক্রি বা লেনদেনের ক্ষেত্রে টার্নওভার কর পরিশোধে যে ছাড় দেওয়া হয়েছে, উল্লিখিত পণ্য ও সেবা খাতগুলোতে ভ্যাট আদায়ের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হবে না। একই সঙ্গে এসব খাতে অবশ্যই নিবন্ধন এবং ভ্যাট রিটার্ন জমা দিতে হবে। তার ভিত্তিতে যার যা রেট আছে (প্রযোজ্য হার) সে অনুযায়ী ‘বাধ্যতামূলক’ ভ্যাট দিতে হবে। এনবিআর সূত্র জানায়, বর্তমানে সেবা খাত আছে ১০০টি এবং স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের সংখ্যা দুই হাজারের বেশি। যেসব পণ্য ও সেবায় ভ্যাট আদায় বাধ্যতামূলক করা হয়, রাজস্ব আহরণের দিক থেকে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাবনাময়।
গত ১৭ জুলাই রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে কাস্টমস আধুনিকায়ন কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ অনুষ্ঠানে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, সবাই চান বিক্রি কম দেখাতে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। রাজস্বে ঘাটতি হবে- এমন কিছু মেনে নেবে না সরকার। ফাঁকি বন্ধে শিগগির ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাঁচ দিন পর এনবিআর এ ঘোষণা দিল।
এনবিআরের ভ্যাট বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, অনেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সরকারের দেওয়া সুযোগ অপব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। এতে করে বিপুল পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকির আশঙ্কা করা হচ্ছে। রাজস্ব আহরণ নিশ্চিত করার স্বার্থে বেশকিছু পণ্য ও সেবায় ‘টার্নওভার নির্বিশেষে’ ভ্যাট আদায়ে নির্দেশ জারির কথা জানিয়ে তিনি বলেন, যে আদেশ দেওয়া হলো তা আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে না। কারণ, আইনের ৫ ধারায় বলা আছে, রাজস্ব আয়ের স্বার্থে সরকার যে কোনো সময় যে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে।
সূত্র জানায়, কয়েকজন ভ্যাট কমিশনার সম্প্রতি এনবিআরকে লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন, নতুন আইন বাস্তবায়ন শুরু হওয়ার পর অনেকেই ভ্যাটের আওতা থেকে বাদ পড়ে গেছে। কেউ কেউ কম বিক্রি দেখাচ্ছে। অথচ, এরা আগে ভ্যাট দিত। এমন বাস্তবতায় চলতি বছর ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা তো পূরণ হবেই না, বরং বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। জানা যায়, চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেটের আওতায় নিয়মিত রিটার্ন জমা দেয় প্রায় ৮ হাজার প্রতিষ্ঠান। নতুন আইনে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত অব্যাহতি সীমা নির্ধারণের ফলে তিন হাজার পাঁচশ’ প্রতিষ্ঠান ভ্যাটের আওতার বাইরে চলে গেছে। ৪ শতাংশ হারে টার্নওভার করের আওতায় প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দুই হাজার। বাকিরা প্রযোজ্য (১৫%) হারে ভ্যাট দেবে। ওই অফিসের এক কর্মকর্তা বলেন, অনেক প্রতিষ্ঠান ভ্যাটের আওতায় বাইরে চলে যাওয়ায় এবার কমপক্ষে এক হাজার কোটি টাকার কম ভ্যাট আহরণ হবে। ঢাকা দক্ষিণ ভ্যাট কমিশনারেট অফিসে ১১ হাজার প্রতিষ্ঠান রিটার্ন জমা দেয়। এর মধ্যে অন্তত দশ হাজার প্রতিষ্ঠান আছে যাদের বিক্রি বছরে ৫০ লাখ টাকার নিচে। এরা সবাই নেটের বাইরে চলে গেছে। অবশিষ্টের মধ্যে ৮০০ প্রতিষ্ঠান টার্নওভার করের আওতায়। সূত্র বলেছে, এখানে ভ্যাটযোগ্য বড় প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ ২০০টি। এ ছাড়া ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারেটের অসংখ্য প্রতিষ্ঠান আওতার বাইরে চলে গেছে বলে জানা গেছে। অন্যান্য ভ্যাট কমিশনারেট থেকে একই চিত্র পাওয়া গেছে। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এ আদেশ জারি করেছে এনবিআর। উল্লেখ্য, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১ লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা ভ্যাট আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে এখনও ধোঁয়াশা : এদিকে নতুন আইন সম্পর্কে মাঠ পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তার পরিস্কার ধারণা নেই। একেকজন ব্যাখ্যা দিচ্ছে একেকভাবে। রয়েছে অস্পষ্টতা। আইনটি বাস্তবায়ন সম্পর্কে এনবিআর থেকে এখন পর্যন্ত স্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়নি। ফলে ভ্যাট আহরণে হযবরল অবস্থা চলছে। ভ্যাট কর্মকর্তারা বলেছেন, আগামী মাসে ভ্যাট রিটার্ন জমা দেওয়ার পর বোঝা যাবে সার্বিক পরিস্থিতি। তবে মনে হচ্ছে, এবার আদায় করাই হবে বড় চ্যালেঞ্জ। মাঠ পর্যায়ে একাধিক ভ্যাট কমিশনার সমকালকে বলেন, ভ্যাটের অব্যাহতি এবং টার্নওভার সীমা বাড়ানোর ফলে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান ভ্যাটের আওতার বাইরে চলে গেছে। এতে করে চলতি অর্থবছর ভ্যাট আহরণ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।
৯০টি পণ্যের তালিকা : এনবিআরের আদেশে উৎপাদন পর্যায়ে যেসব পণ্যে ভ্যাট আদায় বাধ্যতামূলক করা হয় সেগুলো হলো- দুগ্ধজাত পণ্য, তৈরি পোশাক, টিভি, বৈদ্যুতকি বাল্ক্ব,বাইসাইকেল, সিমেন্ট, এয়ারকন্ডিশনার, ফ্রিজ, ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক্স পণ্যসামগ্রী, স্টাচ, গাম, গ্লুকোজ, মোলাসেস, লজেন্স, চুইংগাম, চকোলেট, নুডলস, বিস্কুট, চানাচুর, জ্যাম-জেলি, আচার-সস, চায়না ক্লে, মার্বেল পাথর, এলাম, সোডিয়াম সিলিকেট, গ্লিসারিন, এসিটিক এসিড, মেলামাইন, এন্টিসেপটিক, সকল প্রকার সাবান, ডিটারজেন্ট, দিয়াশলাই, মশার কয়েল, ফোম, পিভিসি পাইপ, প্লাস্টিক পণ্য, টায়ার-টিউব, রাবার প্রোডাক্ট, চামড়াজাত পণ্য, কাঠের পণ্য, পার্টিকেল বোর্ড, ইনসুলেশন বোর্ড, হাডবোর্ড, পাল্প, টয়লেট পেপার, টিস্যু, স্যানিটারি ন্যাপকিন, প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়ালস, উলেন ফেব্রিক্স, কটন ইয়ার্ন, কটন ফেব্রিক্স, সিনথেটিক ফাইবার, নাইলন কার্ড, ফিশিং নেট, সেন্ড পেপার, কার্বন রড, সব ধরনের ইট, সব ধরনের সিরামিক, গ্লাস ওয়্যার, স্ক্যাপ, সব ধরনের এম এস প্রোডাক্ট, স্যানিটারি ওয়্যার, স্টিল ইনগট, নেইলস, অ্যালুমিনিয়াম ফিটিংস ও ফয়েল, ব্লেড, বৈদ্যুতিক পাখা ও যন্ত্রাংশ, গ্যাস বার্নার, ড্রাইসেল ব্যাটারি- ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
সেবা খাতসমূহ : সেবা খাতের মধ্যে রয়েছে হোটেল, রেস্তোরাঁ, ডেকোরেটরস ও ক্যাটারার্স, মোটর গাড়ির গ্যারেজ ও ওয়ার্কশপ, ডকইয়ার্ড, নির্মাণসংস্থা, পণ্যাগার, বন্দর, বিজ্ঞাপনী সংস্থা, ছাপাখানা, নিলাম সংস্থা, ভূমি উন্নয়ন সংস্থা, ভবন নির্মাণ সংস্থা, টেলিফোন-টেলিপ্রিন্টার, ইন্টারনেট সংস্থা, সিমকার্ড সরবরাহকারী, যান্ত্রিক লন্ডি, ইনডেনটিং সংস্থা, ক্লিয়ারিং ও ফরোয়াড়িং সংস্থা, কমিউনিটি সেন্টার, চলচ্চিত্র স্টুডিও, জরিপ সংস্থা, মিস্টান্ন ভাণ্ডার, চলচ্চিত্র পরিবেশক, আসবাবপত্রের উৎপাদক, আসবাবপত্রের বিপণন কেন্দ্র, স্বর্ণকার ও রৌপ্যকার, বীমা কোম্পানি, কুরিয়ার সার্ভিস, বিউটি পার্লার, কলসালট্যান্সি ফার্ম, ইজারদার, অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টিং ফার্ম, শিপিং এজেন্ট, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস ও লঞ্চ ও রেলওয়ে, স্যাটেলাইট ক্যাবল অপারেটর, স্যাটেলাইট চ্যানেল ডিস্ট্রিবিউটর, সিকিউরিটি সার্ভিস, হেলথ ক্লাব ও ফিটনেস সেন্টার, খেলাধুলার আয়োজক, পরিবহন ঠিকাদার, গ্রাফিক্স ডিজাইন, যানবাহন ভাড়া প্রদানকারী, প্রকৌশলী ফার্ম, শব্দ ও আলোক সরঞ্জাম ভাড়া প্রদানকারী, ব্যাকিং ও নন-ব্যাকিং সেবা প্রদানকারী, বিদ্যুৎ বিতরণকারী, চার্টার্ড বিমান, বা ভাড়ায় চালিত হেলিকপ্টার, নিলামকৃত পণ্যের ক্রেতা, ক্রেডিট কার্ড প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত টেইলারিং শপ, মানি চেঞ্জার, অ্যামিউজমেন্ট পার্ক ও থিম পার্ক, লটারি টিকিট বিক্রি, ইমিগ্রেশন উপদেষ্টা, কোচিং সেন্টার, অনুষ্ঠান আয়োজক, তৈরি পোশাক বিপণন, তথ্য প্রযক্তিনির্ভর সেবা, রাইড শেয়ারিং, ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি ও অনলাইনে পণ্য বিক্রিয় ইত্যাদি।