ফিচার ডেস্ক
জীবন কখনোই পুষ্পশয্যা নয়। কঠোর পরিশ্রম, একাগ্রতা ও আত্মবিশ্বাস দিয়েই মানুষ জয় করে ব্যর্থতার পাহাড়, ছুঁয়ে ফেলে সফলতার চূড়া। পৃথিবীর ইতিহাসে যাঁরা অমর হয়ে আছেন, তাঁদের প্রতিটি সাফল্যের পেছনে আছে সংগ্রাম ও অদম্য ইচ্ছাশক্তির গল্প। এমনই পাঁচজন বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিত্বের জীবনে ব্যর্থতা জয় করে এগিয়ে যাওয়ার গল্প নিয়েই আজকের প্রতিবেদন।

বিল গেটস: প্রকল্পে ব্যর্থতার পরও মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা
উইলিয়াম হেনরি গেটস, বিশ্বজুড়ে যিনি বিল গেটস নামে পরিচিত, জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫৫ সালের ২৮ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের সিয়াটলে। লেকসাইড স্কুলে পড়াশোনাকালে থেকেই তিনি কম্পিউটারের প্রতি গভীর আগ্রহী ছিলেন। পরবর্তীতে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও সফটওয়্যার উন্নয়নের স্বপ্নে পড়াশোনা মাঝপথে ছেড়ে দেন।
বন্ধু পল অ্যালেনের সঙ্গে মিলে প্রথম প্রকল্প “ট্রাফ-ও-ডেটা” তৈরি করেছিলেন, যা ট্রাফিক কাউন্টার থেকে তথ্য বিশ্লেষণ করত। উদ্বোধনের দিন যন্ত্রটি কাজ না করায় প্রকল্পটি ব্যর্থ হয়। কিন্তু এ ব্যর্থতাই তাঁকে তৈরি করে আরও দৃঢ় করে তোলে। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে অ্যালেনকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন “মাইক্রোসফট করপোরেশন”। ১৯৮১ সালে তিনি কোম্পানির সিইও ও চেয়ারম্যান হন। ২০০০ সালে সিইও পদ ছাড়লেও চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মাইক্রোসফট ১৯৮৫ সালে আইবিএমের সঙ্গে অংশীদারিত্বে প্রথম বাণিজ্যিক সফটওয়্যার প্রকাশ করে এবং ১৯৯১ সালে স্বাধীনভাবে কাজ শুরু করে। বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তি বিল গেটস তাঁর সম্পদের বড় অংশ মানবকল্যাণে ব্যয় করেন ‘বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন’-এর মাধ্যমে।
ইলন মাস্ক: পরাজয়ের পথ পেরিয়ে টেসলার সাফল্য
ইলন মাস্কের জন্ম ১৯৭১ সালের ২৮ জুন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়াতে। শৈশবে পারিবারিক ভাঙনের মধ্য দিয়েও তিনি প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ হারাননি। ১৯৯৫ সালে ভাই কিমবাল মাস্ককে নিয়ে ‘জিপ-২’ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন, যা সংবাদপত্রের জন্য সফটওয়্যার সরবরাহ করত। পরবর্তীতে ৩০০ মিলিয়ন ডলারে কোম্পানিটি বিক্রি করেন।
এরপর প্রতিষ্ঠা করেন ‘এক্স ডটকম’, যা পরবর্তীতে ‘পেপাল’ নামে অনলাইন পেমেন্ট প্ল্যাটফর্মে রূপ নেয়। পেপাল বিক্রির পর ২০০৩ সালে শুরু করেন ‘টেসলা মোটরস’। প্রাথমিক পর্যায়ে নানা সমালোচনা ও আর্থিক সংকট কাটিয়ে তিনি তৈরি করেন বৈদ্যুতিক গাড়ি শিল্পের বিপ্লব।
এছাড়া তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন সোলারসিটি, ওপেনএআই, নিউরালিংক ও দ্য বোরিং কোম্পানি। ২০২২ সালে টুইটারের নিয়ন্ত্রণ নেন তিনি। বর্তমানে মাস্ক বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তি, যার সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১৯৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
লিওনেল মেসি: হরমোন ঘাটতি জয় করে ফুটবলের রাজপুত্র
১৯৮৭ সালের ২৪ জুন আর্জেন্টিনার রোজারিও শহরে জন্ম নেন লিওনেল মেসি। ছোটবেলায় ‘গ্রোথ হরমোন ডেফিসিয়েন্সি’ রোগে আক্রান্ত হন, যার চিকিৎসা বাবার পক্ষে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। বার্সেলোনার এক স্কাউট মেসির প্রতিভা চিনে তাঁকে নিয়ে যান স্পেনে। ক্লাবটি তাঁর চিকিৎসার দায়িত্ব নেয় এবং মেসিকে একাডেমিতে ভর্তি করায়।
১৩ বছর বয়সে শুরু হয় তাঁর ফুটবলযাত্রা, যা পরবর্তীতে বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে কিংবদন্তি অধ্যায়ে পরিণত হয়। সাতবারের ফিফা বর্ষসেরা এই তারকা বার্সেলোনার হয়ে জিতেছেন ১০টি লা লিগা ও চারটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগসহ অসংখ্য শিরোপা। আর্জেন্টিনার হয়ে ২০২২ সালে বিশ্বকাপ জয় করে ক্যারিয়ার পূর্ণতা দেন তিনি।
জ্যাক মা: আর্থিক টানাপোড়েন জয় করে আলিবাবার কর্ণধার
১৯৬৪ সালের ১৫ অক্টোবর চীনের হাংঝু শহরে জন্ম নেন জ্যাক মা। শৈশবে অর্থাভাবের কারণে তাঁকে নানা প্রতিকূলতার মুখে পড়তে হয়। ইংরেজি শেখার জন্য পর্যটকদের সঙ্গে কাজ করতেন বিনা পারিশ্রমিকে।
দুইবার ভর্তি পরীক্ষায় ব্যর্থ হলেও তৃতীয়বারে উত্তীর্ণ হয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে প্রথমবারের মতো ইন্টারনেট দেখেন এবং অনলাইন ব্যবসার ধারণা পান।
১৯৯৯ সালে ১৭ জন বন্ধুকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আলিবাবা’। রপ্তানিকারকদের জন্য তৈরি এই অনলাইন মার্কেটপ্লেস দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়। গোল্ডম্যান স্যাকস ও সফটব্যাংকের বিনিয়োগে আলিবাবা বিশ্ববাজারে নিজের অবস্থান তৈরি করে। আজ তিনি চীনের অন্যতম প্রভাবশালী উদ্যোক্তা ও প্রযুক্তি ব্যক্তিত্ব।
কর্নেল স্যান্ডার্স: ব্যর্থতার পর কেএফসির স্বপ্নপূরণ
১৮৯০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানার হেনরিভিলেতে জন্মগ্রহণ করেন হারল্যান্ড ডেভিড স্যান্ডার্স। শৈশবে বাবার মৃত্যু ও দারিদ্র্যের কারণে নানা ছোটখাটো কাজ করে জীবন শুরু করেন। ষষ্ঠ শ্রেণির পর পড়াশোনা ছেড়ে চাকরিতে মনোনিবেশ করেন।
ক্যারিয়ারের নানা ব্যর্থতার পর কেন্টাকির কর্বিন শহরে একটি গ্যাসস্টেশন পরিচালনা শুরু করেন। সেখানে যাত্রীদের জন্য নিজ হাতে রান্না করা খাবার বিক্রি করতেন। তাঁর বিশেষ মশলা ও ভাজার পদ্ধতি জনপ্রিয়তা পায়। পরে ৬০০টিরও বেশি রেস্টুরেন্টের সঙ্গে ফ্র্যাঞ্চাইজি চুক্তি করেন।
১৯৬৪ সালে তাঁর ব্যবসা বিনিয়োগকারীদের কাছে ২ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি করেন। ‘কেন্টাকি ফ্রায়েড চিকেন’ বা ‘কেএফসি’ দ্রুত বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বর্তমানে ১১৮টি দেশে কেএফসির ২০ হাজারেরও বেশি শাখা রয়েছে।
বিশ্বের এই পাঁচ সফল মানুষের গল্প প্রমাণ করে—ব্যর্থতা কোনো শেষ নয়, বরং তা সফলতার পথচলারই প্রথম ধাপ। অধ্যবসায়, আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ় মনোবল দিয়েই জীবনের কঠিনতম বাধা জয় করা সম্ভব।






