রাশিদুল হাসান বুলবুলঃ
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনের কিংবদন্তি অভিনেত্রী ববিতা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে দর্শকের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। তাঁর অভিনয় ও ব্যক্তিত্ব এতটাই গভীর প্রভাব ফেলেছে যে, শহর থেকে গ্রাম—সবখানেই তিনি হয়ে উঠেছেন এক অনন্য সাংস্কৃতিক প্রতীক।
টেলিভিশন উপস্থাপক ও কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান নির্মাতা শাইখ সিরাজের বর্ণনায় ববিতার জনপ্রিয়তার এক বাস্তব চিত্র পাওয়া যায়। প্রায় তিন দশক আগে শুটিংয়ের কাজে যশোরের এক প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে তিনি দেখেন, এক কৃষকের বাড়ির বেড়ার দেয়াল সাজানো পুরোপুরি চিত্রালী পত্রিকার পাতায়। সেই সময় জনপ্রিয় এ সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রতি শুক্রবার প্রকাশিত হতো চলচ্চিত্র জগতের খবর ও তারকাদের ছবি। যে সংখ্যার প্রচ্ছদে ববিতার বড় একটি ছবি ছাপা হয়েছিল, সেই সংখ্যার পৃষ্ঠা দিয়েই কৃষক তার ঘরের বেড়ার ফাঁকফোকর ঢেকেছিলেন।
শাইখ সিরাজের প্রশ্নের জবাবে কৃষক জানান, তিনি ববিতার ভক্ত। তাঁর অভিনয় তাকে মুগ্ধ করে, তাই ববিতার ছবি সংরক্ষণ করতে তিনি একাধিকবার একই সংখ্যা কিনেছেন। বৃষ্টিতে কাগজ নষ্ট হয়ে গেলে নতুন কপি দিয়ে দেয়াল পুনরায় সাজাতেন। কৃষক আরও বলেন, ববিতার নতুন ছবি মুক্তি পেলে তিনি ও আশপাশের অনেক পরিবার তা দেখতে সিনেমা হলে যেতেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল নায়িকার একটি বড় ছবি ফ্রেমে বাঁধিয়ে ঘরে টাঙানোর, যদিও আর্থিক কারণে তা সম্ভব হয়নি।
এই ঘটনার মাধ্যমে বোঝা যায়, সিনেমা শুধু শহরের প্রেক্ষাগৃহে সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং গ্রামীণ সমাজেও তা গভীর প্রভাব ফেলেছিল। ববিতা সেই প্রভাবের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিলেন।
পরবর্তী সময়ে প্রবাসেও তাঁর জনপ্রিয়তার প্রমাণ মেলে। কয়েক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে একটি বাংলা রেস্টুরেন্টের দেয়ালজুড়ে ববিতার পুরনো প্রচ্ছদ ছবি ও পোস্টার দিয়ে সাজানো হয়। রেস্টুরেন্টটির মালিক দম্পতি জানান, তাঁরা দুজনেই ববিতার ভক্ত। চিত্রালী ও বিচিত্রা পত্রিকায় প্রকাশিত ববিতার প্রচ্ছদগুলো তাঁরা সংগ্রহ করে রেখেছিলেন দীর্ঘদিন ধরে। নিউইয়র্কে রেস্টুরেন্ট চালুর পর প্রিয় অভিনেত্রীর সেই ছবিগুলো দিয়েই দেয়াল সজ্জিত করেন, যাতে আগত দর্শনার্থীরাও দেখতে পারেন তাঁদের প্রিয় তারকার স্মৃতি।
যশোরের এক কৃষকের বেড়ার ঘর থেকে শুরু করে নিউইয়র্কের রেস্টুরেন্টের দেয়াল—এই দুই প্রান্তিক ভৌগোলিক স্থানে ববিতার প্রতি মানুষের ভালোবাসা প্রমাণ করে, একজন শিল্পীর প্রভাব সময় ও স্থান অতিক্রম করতে পারে। এটি কেবল জনপ্রিয়তার নয়, সাংস্কৃতিক সংযোগেরও প্রতীক।
দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ববিতা অভিনয় করেছেন শতাধিক চলচ্চিত্রে। “অশিক্ষিত”, “নয়নমণি”, “দহন”, “গোলাপী এখন ট্রেনে”, “নদী ও নারীরা”সহ অসংখ্য চলচ্চিত্রে তাঁর শক্তিশালী অভিনয় তাঁকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দিয়েছে। তিনি কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র “নদী ও নারীরা”-এর নায়িকা হিসেবেও আলোচনায় আসেন।
ব্যক্তিজীবনে ববিতা সমাজসেবামূলক কাজেও সক্রিয়। পরিবেশবান্ধব জীবনযাপন, বৃক্ষরোপণ ও প্রাণীপ্রেম তাঁর ব্যক্তিত্বের অংশ হয়ে উঠেছে। শাইখ সিরাজের কৃষিবিষয়ক অনুষ্ঠানে তাঁকে দেখা গেছে ছাদবাগান পরিচর্যা করতে, গাছ ও পাখির প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে ববিতা শুধু একজন অভিনেত্রী নন, বরং এক সাংস্কৃতিক প্রতীক—যাঁর কাজ, ব্যক্তিত্ব ও জনপ্রিয়তা আজও মানুষের হৃদয়ে অমলিন। তাঁর প্রতি এই ভালোবাসা প্রমাণ করে, সত্যিকারের শিল্পী কখনো সময়ের সীমানায় আবদ্ধ থাকেন না।


