দুই বছরের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত সুদান: দারফুর দখলে আরএসএফ, দেড় লাখের বেশি নিহত

দুই বছরের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত সুদান: দারফুর দখলে আরএসএফ, দেড় লাখের বেশি নিহত

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে চলমান গৃহযুদ্ধে সুদানে দেড় লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে দুর্ভিক্ষ, বাস্তুচ্যুত হয়েছেন প্রায় এক কোটি ২০ লাখ মানুষ। সাম্প্রতিক সময়ে আধাসামরিক বাহিনী র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) দারফুরের রাজধানী এল-ফাশের দখল করে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, যা সুদানের মানবিক সংকটকে আরও গভীর করেছে।

আরএসএফ গত ২৭ অক্টোবর পশ্চিমাঞ্চলীয় দারফুরে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা সর্ববৃহৎ শহর এল-ফাশের দখল করে। ১৮ মাস অবরোধের পর শহরটি পতনের সঙ্গে সঙ্গে বাহিনীটি ব্যাপক হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ও স্থানীয় সূত্র জানায়, ওই হামলায় হাজারো মানুষ নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে প্রায় ৪৬০ জন ছিলেন হাসপাতালের রোগী ও স্বাস্থ্যকর্মী।

সুদানের বর্তমান সংঘাতের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন দুই সামরিক নেতা—সুদানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং আধাসামরিক আরএসএফের প্রধান জেনারেল মোহামেদ হামদান দাগালো, যিনি হেমেডটি নামে বেশি পরিচিত। তারা একসময় ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিলেন এবং ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করতেও একসঙ্গে ভূমিকা রাখেন। কিন্তু ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর তাদের সম্পর্ক ভেঙে যায় এবং এরপর থেকেই দুই পক্ষের সংঘর্ষ শুরু হয়।

র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) গঠিত হয় ২০১৩ সালে। এর মূল ভিত্তি ছিল জানজাউইদ মিলিশিয়া, যারা দারফুরে বিদ্রোহ দমনকালে ব্যাপক নৃশংসতার অভিযোগে অভিযুক্ত। আন্তর্জাতিক নিন্দা সত্ত্বেও তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশির এই বাহিনীকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেন এবং এর নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল দাগালো।

২০১৯ সালে আল-বশির ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দাগালো সামরিক সরকারের উপপ্রধান হন। পরবর্তীতে তিনি আরএসএফকে একটি শক্তিশালী ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলেন। বাহিনীটি ইয়েমেন ও লিবিয়ার সংঘাতে অংশ নেয় এবং সুদানের বিভিন্ন সোনার খনিতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অভিযোগ অনুযায়ী, আরএসএফ ২০১৯ সালের গণবিক্ষোভে ১২০ জনের বেশি প্রতিবাদকারীকে হত্যা করে।
চলতি বছরের জুনে আরএসএফ সুদানের সীমান্তবর্তী লিবিয়া ও মিশর সংলগ্ন অঞ্চল দখল করে। এরপর অক্টোবরের শেষ দিকে তারা দারফুরের প্রায় সমগ্র অঞ্চল এবং পার্শ্ববর্তী কোর্দোফানের সিংহভাগ এলাকাও নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনে। বর্তমানে হেমেডটি কার্যত সুদানের পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছেন। আন্তর্জাতিক মহল আশঙ্কা করছে, তার এই উত্থান সুদানের গৃহযুদ্ধকে আরও দীর্ঘায়িত করবে এবং মানবিক বিপর্যয়কে তীব্র করবে।

জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, সুদানে এখন বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ মানবিক সংকট চলছে। সংঘাত, দুর্ভিক্ষ ও বাস্তুচ্যুতি মিলিয়ে প্রায় এক তৃতীয়াংশ জনগণ তীব্র খাদ্য সংকটে ভুগছে। অনেক এলাকায় ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না, কারণ আরএসএফ ও সরকারি বাহিনীর মধ্যে তীব্র লড়াই অব্যাহত রয়েছে।

হেমেডটির জন্ম দক্ষিণ দারফুরে, আনুমানিক ১৯৭৫ সালে। তরুণ বয়সে তিনি উট ব্যবসায়ী ছিলেন এবং পরে জানজাউইদ মিলিশিয়ায় যোগ দেন। ২০০৩ সালে দারফুর বিদ্রোহ দমনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখেন, যেখানে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ ওঠে। ২০০৪ সালে আফ্রিকান ইউনিয়ন তার নেতৃত্বাধীন ইউনিটকে আদওয়া গ্রামে ১২৬ জনকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করে।

সময় গড়িয়ে তিনি দারফুরের “নতুন সুলতান” হিসেবে পরিচিতি পান। তার নেতৃত্বে আরএসএফ দারফুরের সোনার খনি দখল করে বিশাল অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। ২০১৯ সালের পর তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও প্রভাব বিস্তার শুরু করেন। হেমেডটি সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা গড়ে তোলেন, বিশেষ করে ইয়েমেন যুদ্ধে সৈন্য পাঠানোর মাধ্যমে। বিভিন্ন সূত্রের দাবি, সংযুক্ত আরব আমিরাত এখনো আরএসএফকে সামরিক সহায়তা দিচ্ছে, যদিও দেশটি আনুষ্ঠানিকভাবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

৬ নভেম্বর আরএসএফ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন মানবিক যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে সম্মত হওয়ার ঘোষণা দেয়, তবে পরদিনই খার্তুমের কাছে বিস্ফোরণের খবর পাওয়া যায়। এতে শান্তি আলোচনা নিয়ে অনিশ্চয়তা আরও বেড়েছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, যদি এই যুদ্ধবিরতি আরেকটি কৌশল হয়ে থাকে, তবে সুদানের জনগণকেই এর মাশুল দিতে হবে।

বর্তমানে সুদানে স্থিতিশীলতা ফেরানোর কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। হেমেডটির আরএসএফ বাহিনী ও সরকারি সেনাবাহিনীর মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব অব্যাহত থাকলে দেশটি আরও গভীর মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে পারে।

সূত্র: বিবিসি, দ্য ইকোনমিস্ট

আন্তর্জাতিক