নারায়ণগঞ্জের মানবিক জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞার বিদায়

নারায়ণগঞ্জের মানবিক জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞার বিদায়

 

নিজস্ব প্রতিবেদক

নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই একের পর এক মানবিক কার্যক্রমের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা। অবশেষে, গত রোববার (১৬ নভেম্বর) নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আলমগীর হোসেনের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করে বিদায় নেন তিনি। তার নতুন কর্মস্থল চট্টগ্রাম, যেখানে তিনি জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদান করবেন।

বিদায় উপলক্ষে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ফুলেল শুভেচ্ছা জানাতে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উপস্থিত হন। তাদের উপস্থিতিতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ফুলে ফুলে ভরে ওঠে। এসময় শত শত মানুষ জেলা প্রশাসকের সঙ্গে বিদায়ী কুশলাদি বিনিময় করেন। সন্ধ্যায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসকের বাংলোতে আনুষ্ঠানিক বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয়।

নিজের বিদায় অনুষ্ঠানের মাঝেও জেলা প্রশাসক মিঞা তার মানবিকতার আরেকটি উদাহরণ রেখে যান। তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধী এক কবিকে নিজ বাসায় আমন্ত্রণ জানান এবং তাকে একটি অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক হুইলচেয়ার উপহার দেন। কবি ইমরান আহমেদ (৪৬), যিনি শারীরিক প্রতিবন্ধী হলেও একজন লেখক ও কবি, তার পরিবারের আর্থিক অবস্থার কারণে হুইলচেয়ার কেনার উপায় ছিল না। জেলা প্রশাসক মিঞা তার জীবনে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে এই হুইলচেয়ার উপহার দিয়ে ইমরান ও তার পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

ইমরান আহমেদ, যিনি জন্মগতভাবে শারীরিকভাবে অক্ষম, বলেন, “এটি শুধু একটি হুইলচেয়ার নয়, এটি আমার জীবনে নতুন আশার দিগন্ত, চলার পথে শক্তি, সাহস এবং আলোর প্রদীপ।” তিনি আরও বলেন, জেলা প্রশাসক তার প্রতি অভিভাবকের মতো দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সহযোগিতা করেছেন এবং তার অসহায়ত্বের কথা শোনার পর এই উদারতা প্রদর্শন করেছেন।

জেলা প্রশাসক মিঞার মানবিক কর্মকাণ্ডের আরও অনেক উদাহরণ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সোহাগকে স্মার্টফোন উপহার দেওয়া, সালমা জেরিনকে ল্যাপটপ দেওয়া, প্রতিবন্ধীদের জন্য হুইলচেয়ার ও ইলেকট্রনিক চেয়ার বিতরণ, অসহায় রোগীদের চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং বিভিন্ন সামাজিক কাজের জন্য অর্থ ও উপকরণ প্রদান। এছাড়া, জুলাই শহীদ ২১ পরিবারের জন্য ৪২ লাখ টাকা এবং আহত যোদ্ধাদের জন্য অনুদান প্রদানও তার মানবিক উদ্যোগের অংশ ছিল।

এছাড়া, তার উদ্যোগে নারায়ণগঞ্জে গ্রিন অ্যান্ড ক্লিন কর্মসূচি, মাধ্যমিক শিক্ষার মান উন্নয়ন এবং জেলা হাসপাতালগুলোর উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। বিশেষত, নারায়ণগঞ্জ শহরের হাসপাতালগুলোতে অত্যাধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম প্রদান এবং ফুটবল একাডেমির শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় ক্রীড়া সরঞ্জাম সরবরাহের মাধ্যমে তিনি অবদান রেখেছেন।

তবে, তার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ছিল জেলা প্রশাসক হিসেবে স্বচ্ছতা ও মানবিকতা প্রতিষ্ঠা করা। পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচিতে নিজ হাতে ডাস্টবিনে সিরিঞ্জ ফেলে, জনবান্ধব প্রশাসক হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার জন্য ৩০ জন ইউপি কর্মকর্তা বদলির মাধ্যমে স্বচ্ছতার উদাহরণ স্থাপন করেছিলেন। এছাড়া, নারায়ণগঞ্জে তিনি নারী ফুটবলারদের স্বপ্ন পূরণে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন এবং মায়ের আঁচল সাহিত্য সামাজিক মৈত্রী পরিষদসহ নানা সামাজিক উদ্যোগে সহায়তা করেছিলেন।

এছাড়া, তার গ্রিন অ্যান্ড ক্লিন নারায়ণগঞ্জ কর্মসূচি, শিক্ষকতা ও শিক্ষা সহায়তা কর্মসূচি, শিশুদের জন্য খেলাধুলার সহায়তা এবং দরিদ্রদের জন্য শীতের রাতে কম্বল বিতরণসহ বহু মানবিক কর্মসূচি ছিল।

২০২৪ সালের ২ নভেম্বর রাজবাড়ীতে যোগদান করেই তিনি মানবিক ডিসি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। সেখানেও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে এবং সামাজিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে তিনি মানুষের মন জয় করেছিলেন।

মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা ১৯৭৯ সালের অক্টোবর মাসে টাঙ্গাইলের ভুয়াপুরে একটি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করার পর যুক্তরাজ্য থেকে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় এমএসসি করেন। ২০০৬ সালে ২৫তম বিসিএসের মাধ্যমে প্রশাসনে যোগদান করেন। তার কর্মজীবনে লালমনিরহাট, নীলফামারী, গাইবান্ধা, মৌলভীবাজার, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন জেলা প্রশাসনে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন এবং ইউএনও হিসেবে শ্রেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে স্বীকৃত হয়েছেন।

জাহিদুল ইসলাম মিঞার বিদায় উপলক্ষে নারায়ণগঞ্জের সাধারণ মানুষ তার মানবিকতা, বিনয় ও জনবান্ধব আচরণের জন্য তাকে চিরকাল স্মরণ করবে বলে জানিয়েছেন।

সারাদেশ