ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফেরাতে ভারতের কাছে চিঠি পাঠানোর প্রস্তুতি

ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফেরাতে ভারতের কাছে চিঠি পাঠানোর প্রস্তুতি

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে দেশে ফিরিয়ে আনতে ভারতের কাছে নোট ভারবাল পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। মঙ্গলবার রাতের দিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ তথ্য নিশ্চিত করেন। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার পর উচ্চপর্যায়ের এই কূটনৈতিক পদক্ষেপকে বাংলাদেশ সরকারের চলমান আইনি ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

তৌহিদ হোসেন জানান, দুই সাবেক শীর্ষ নেতাকে ফেরত চেয়ে ভারতের কাছে এখনো কোনো চিঠি পাঠানো হয়নি। তবে সংশ্লিষ্ট নথি প্রস্তুত করার কাজ চলমান, এবং তা দ্রুতই পাঠানো হতে পারে। তিনি বলেন, নোট ভারবালের মাধ্যমে বিষয়টি ভারত সরকারকে জানানো হবে। এতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাম্প্রতিক রায় উল্লেখ করা হবে এবং সেই রায়ের প্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানানো হবে। তবে রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি পাঠানো হবে না; বরং নোট ভারবালে রায়ের সারসংক্ষেপ ও হস্তান্তরের অনুরোধই থাকবে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সম্প্রতি জুলাই আন্দোলনের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দুই প্রাক্তন নেতাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। এই রায় ঘোষণার পর দেশ-বিদেশে আলোচনার সৃষ্টি হয়। রায় ঘোষণার পরদিনই পররাষ্ট্র উপদেষ্টা জানান, সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওই রাতেই বা পরের দিন সকালে ভারতকে চিঠি পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে। তবে কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার আনুষ্ঠানিকতা নিশ্চিত করতে নথি প্রস্তুত কিছুটা সময় নিচ্ছে।

প্রসঙ্গত, গত বছরের ৫ আগস্ট তীব্র গণআন্দোলনের মুখে তৎকালীন সরকারের পতন ঘটে। একই সময়ে শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেন বলে সরকারি সূত্রে জানা যায়। রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকার ভারতের কাছে প্রত্যার্পণ চুক্তির আওতায় তাঁকে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে প্রথম চিঠি পাঠিয়েছিল। তবে সেই চিঠির কোনো উত্তর ভারতের পক্ষ থেকে এখনো পাওয়া যায়নি। নতুন চিঠি পাঠানোর বিষয়টি মূলত ট্রাইব্যুনালের সাম্প্রতিক রায়ের প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে নেওয়া হয়েছে।

আইন ও কূটনীতি–সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, নোট ভারবাল হলো রাষ্ট্র-রাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রচলিত একটি আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ পদ্ধতি, যেখানে কোনো দেশের সরকার অপর দেশের কাছে নির্দিষ্ট অনুরোধ বা অবস্থান জানিয়ে থাকে। সাধারণত এর মধ্যে রাজনৈতিক ব্যাখ্যা বা ব্যক্তিগত মন্তব্য থাকে না; থাকে শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক তথ্য ও কৌশলগত অবস্থান। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে পাঠানো নোট ভারবালে মূলত বিচারিক প্রক্রিয়ার অগ্রগতি, ট্রাইব্যুনালের রায়, এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে দুই সাবেক নেতাকে হস্তান্তরের অনুরোধ জানানো হবে।

কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, যেহেতু সংশ্লিষ্ট দুই ব্যক্তি বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন বলে জানা যায়, তাই এই প্রক্রিয়ায় ভারতের সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। দুটি দেশের মধ্যে প্রত্যার্পণ চুক্তি থাকলেও সেই চুক্তির প্রয়োগ নির্ভর করে রাজনৈতিক পরিবেশ, আইনি যাচাই-বাছাই এবং পারস্পরিক আস্থার ওপর। ভারত চাইলে আবেদনের প্রেক্ষিতে আইনি মূল্যায়ন শুরু করতে পারে বা অতিরিক্ত তথ্য চাইতে পারে। আবার ভারতের অভ্যন্তরীণ আইনি প্রক্রিয়ার কারণেও সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগতে পারে।

একই সঙ্গে বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ট্রাইব্যুনালের রায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন আলোচনার জন্ম দিতে পারে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামোর অংশ হওয়ায় প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা এখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই প্রক্রিয়ার ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় বিচার ও দায়বদ্ধতা–সংক্রান্ত আলোচনাও নতুন মাত্রা পেতে পারে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, নোট ভারবাল পাঠানো হলে তার ভিত্তিতে ভারতের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষা করবে সরকার। প্রতিক্রিয়া পাওয়ার পর পরবর্তী কূটনৈতিক ও আইনি পদক্ষেপ নির্ধারণ করা হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার রায় কার্যকর ও আইনি প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতিও চালিয়ে যাচ্ছে।

উল্লেখ্য, আন্দোলনের সময় সংঘটিত ঘটনাবলি নিয়ে বিভিন্ন মামলায় তদন্ত ও বিচারকার্য চলমান। সরকার জানিয়েছে, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং আইনের শাসন শক্তিশালী করাই তাদের মূল লক্ষ্য। এর অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় কার্যকর করতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চাওয়া হচ্ছে। নোট ভারবাল পাঠানোর সিদ্ধান্ত সেই বৃহত্তর প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, নথি প্রস্তুত সম্পন্ন হলে তা যথাযথ কূটনৈতিক মাধ্যমে ভারতের কাছে প্রেরণ করা হবে। এর পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ভর করবে দুই দেশের পারস্পরিক যোগাযোগ, আইনি মূল্যায়ন এবং কূটনৈতিক আলোচনার ওপর। এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে অগ্রগতি হলে মন্ত্রণালয় তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানাবে।

জাতীয়